আর্সেনিক (Arsenic) ধূসর আভাযুক্ত সাদা রং বিশিষ্ট ভঙ্গুর
প্রকৃতির একটি অর্ধধাতু বা উপধাতু। এটির রাসায়নিক সংকেত As, আণবিক সংখ্যা
৩৩, আণবিক ভর ৭৪.৯২। প্রকৃতিতে আর্সেনিক বিভিন্ন যৌগ আকারে প্রচুর পরিমাণে
পাওয়া যায়। মানবদেহ, সমুদ্র এবং মৃত্তিকায় যৎসামান্য আর্সেনিক বিদ্যমান।
অর্ধপরিবাহী বা সেমিকন্ডাক্টর, শংকর ধাতু ও ঝালাইকারক তৈরিতে আর্সেনিক
বহুল পরিমাণে ব্যবহূত হয়। প্রকৃতির আর্সেনিক অধিকাংশ ক্ষেত্রেই
জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর নয়। তবে সাম্প্রতিক কালে মনুষ্যসৃষ্ট
কার্যাবলি অধিকমাত্রায় বেড়ে যাওয়ায় পরিবেশে আর্সেনিকের ঘনত্ব বৃদ্ধি
পেয়েছে এবং পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের বাতাস, মাটি ও পানি আর্সেনিক দূষিত
হয়ে বিবিধ প্রকার মারাত্মক স্বাস্থ্য সমস্যার সৃষ্টি করছে। আর্সেনিক ও
আর্সেনিক যৌগ মানব কল্যাণে বিভিন্নভাবে ব্যবহূত হচ্ছে, তবে নির্দিষ্ট
পরিমাণের বেশি হলে এটি মারাত্মক ঘাতকে পরিণত হয়। স্বাভাবিকভাবে প্রকৃতিতে
আর্সেনিক খুবই কম পরিমাণে থাকে। তবে কোনো কোনো কারণে আর্সেনিকের তীব্রতা
বৃদ্ধি পেতে পারে, যেমন ধাতু নিষ্কাশন চুল্লীর নিঃসরণ। নদীর পানিতে
আর্সেনিক ঘনত্ব স্বাভাবিক অবস্থায় কম থাকে, তবে যেসব স্থানে ভূ-তাপীয় জল
বা খনি আহরণ চলে সেখানে এর ব্যতিক্রম দেখা যায়।
আগ্নেয়, রূপান্তরিত ও পাললিক শিলায় আর্সেনিকের পরিমাণ ভিন্ন ভিন্ন। সাধারণত আগ্নেয় এবং রূপান্তরিত শিলার চেয়ে পাললিক শিলায় আর্সেনিক বেশি পরিমাণে উপস্থিত থাকে। পাললিক শিলায় আর্সেনিকের তীব্রতা ও সঞ্চিত হওয়ার ধরনের মধ্যে বেশ ভিন্নতা রয়েছে। অসামুদ্রিক কর্দমশিলায় আর্সেনিক সাধারণত কর্দম খনিজ দ্বারা বিশোষিত হয়। বেলেপাথর ও কার্বনেটে আর্সেনিকের পরিমাণ কম, গড়ে কিলোগ্রাম প্রতি ১ মিলিগ্রাম। অধিকাংশ জলব্যবস্থায় প্রলম্বিত ও নিম্নস্থ অবক্ষেপসমূহ বেশ উচ্চমাত্রার আর্সেনিক ধারণ করে। কয়লা ২,০০০ মিগ্রা/কিলোগ্রাম পর্যন্ত আর্সেনিক ধারণ করতে সক্ষম।
আগাছা ও কীটনাশক হিসেবে আর্সেনিকের প্রয়োগ আর্সেনিক দূষণের একটি প্রধান উৎস। উচ্চ চাপযুক্ত স্প্রের ব্যাপক ব্যবহার শুধু মাটি ও গাছপালার দূষণই ঘটায় না, পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের বাতাস ও ভূ-পৃষ্ঠস্থ পানিকেও দূষিত করে তোলে। অনেক ক্ষেত্রে আর্সেনিক ছিটানো পরিত্যক্ত তুলা ক্ষেত পোড়ালে বায়ু দূষণ ঘটে। বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কিছু অঞ্চলে এরকম ঘটতে দেখা গেছে। ভূ-পৃষ্ঠস্থ পানিতে আর্সেনিক দূষণের প্রধান প্রধান উৎস হচ্ছে গার্হস্থ্য ও কলকারখানার বর্জ্য পানি, কাঠের বৈদ্যুতিক খুঁটি, খনি থেকে অবর ধাতু (base metal) উত্তোলন ও নিষ্কাশন এবং দূষিত অ্যারোসলের প্রতিক্রিয়া।
আর্সেনিক দূষণ একটি Global Problem. পৃথিবীর সকল মহাদেশের ৫০টির মতো দেশে ভূগর্ভস্থ বা ভূপরিস্থ পানিতে উচ্চমাত্রার আর্সেনিক শনাক্ত করা হয়েছে। তাইওয়ানে প্রথম শনাক্তকরণের পর থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ক্রমান্বয়ে আর্সেনিক দূষণ শনাক্ত করা হয়েছে। সর্বাধিক দূষণ আক্রান্ত এলাকা হচ্ছে- ল্যাটিন আমেরিকা (আর্জেন্টিনা, চিলি, মেক্সিকো, নিকাবগুয়া ও অন্যান্য দেশ); দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া (ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ড, লাওস, মিয়ানমার) ও দক্ষিণ এশিয়া (বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, পাকিস্তান)। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, স্পেন, ইটালী, জার্মানি, যুক্তরাজ্য, চীন, ব্রাজিল, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, ইত্যাদি দেশে বিভিন্ন মাত্রার আর্সেনিক দূষণ রয়েছে। আক্রান্ত বা ঝুঁকিগ্রস্থ জনসংখ্যার হিসেবে বাংলাদেশ সর্বাধিক দূষণগ্রস্থ দেশ হিসেবে পরিগণিত হয়েছে।
খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ অব্দে কাঁসার শঙ্কর তৈরিতে আর্সেনিক যৌগ ব্যবহূত হতো। খ্রিস্টপূর্ব ৪০০ অব্দের আগে থেকে ওষুধ হিসেবে এর প্রচলন ছিল। কীটনাশকের যৌগ হিসেবে আর্সেনিকের ব্যবহার প্রাচীনকাল থেকেই লক্ষ্য করা যায়। আঙ্গুর ক্ষেতকে পোকার আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য সান্দারাচ (রিয়ালগার বা লোহিত আর্সেনিক সালফাইড) ব্যবহার করা হতো। চীনারা সম্ভবত দশ শতক থেকে আর্সেনিক যৌগকে কীটনাশক হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করে। মধ্যযুগেও এটি কৃষিতে ব্যাপক হারে প্রয়োগ করা হতো। ১৮৬৮ সালে একজন মার্কিন কৃষক কর্তৃক আলুর পোকা নিয়ন্ত্রণে প্যারিস গ্রিন (কপার অ্যাসিটো-আর্সেনাইট) আবিষ্কারের পর থেকে কৃষিতে কীটনাশক হিসেবে আর্সেনিকের প্রয়োগ ব্যাপক হয়ে ওঠে। প্যারিস গ্রিনের সাফল্য কীটনাশক হিসেবে লন্ডন পার্পলের (কিছু জৈব পদার্থের সঙ্গে ক্যালশিয়াম আর্সিনেট ও আর্সেনাইটের মিশ্রণ) পরীক্ষাকে উৎসাহিত করে এবং দ্রুত কৃষিতে এর প্রয়োগ শুরু হয়। পরবর্তী সময়ে আরও কয়েকটি আর্সেনিক যৌগ কীটনাশক হিসেবে প্রবর্তিত হয়। এর পর কিছু অজৈব আর্সেনিক যৌগের ছোটখাটো ব্যবহার শুরু হয় প্রধানত আগাছানাশক হিসেবে। কিন্তু বর্তমান কালে আগাছানাশক হিসেবে আর্সেনিক যৌগের ব্যবহার একেবারেই কমে এসেছে। সাম্প্রতিক অতীতে অবশ্য কাঠ সংরক্ষণে ক্রোমেটেড কপার আর্সিনেট ও অ্যামোনিয়াকল কপার আর্সিনেটের ব্যবহার খুবই চালু ছিল। অজৈব আর্সেনিক যৌগ ছাড়াও জৈব আর্সেনিক যৌগসমূহ যেমন: মনোসোডিয়াম মিথানো-আর্সোনেট (MSMA), ডাই-সোডিয়াম মিথানো-আর্সোনেট (DSMA), আর্সেনিক এসিড এবং ডাই-মিথিলারসনিক এসিডের ব্যবহার ১৯৭০ দশকের মাঝামাঝি থেকে বাড়তির দিকে এবং বর্তমানে পরিমাণের দিক থেকে এগুলি সবচেয়ে বেশি ব্যবহূত হচ্ছে।
আর্সেনিক দূষণ ভারতের পশ্চিমবঙ্গে আর্সেনিক দূষণ ধরা পড়ার পর থেকে বাংলাদেশের ভূগর্ভস্থ পানিতে বিশেষ করে পশ্চিমাঞ্চলীয় সীমান্ত জেলাসমূহে আর্সেনিক দূষণের আশঙ্কা দেখা দেয়। বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্য ও প্রকৌশল অধিদপ্তর ১৯৯৩ সালে নবাবগঞ্জ সদর (চাঁপাই নবাবগঞ্জ) উপজেলার বড়ঘরিয়া মৌজায় কয়েকটি কূপে পরীক্ষা চালিয়ে সর্বপ্রথম ভূগর্ভস্থ পানিতে আর্সেনিকের উপস্থিতি লক্ষ্য করে। ১৯৯৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগে (School of Environmental Sciences – SOES/ এস.ও.ই.এস) অনুষ্ঠিত একটি সেমিনারের পর বিষয়টি জনসমক্ষে আসে। এর পর থেকেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, জনস্বাস্থ্য ও প্রকৌশল অধিদপ্তর, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর প্রিভেনটিভ এন্ড সোশাল মেডিসিন (নিপসম), বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (বি.ডব্লিউ.ডি.বি)-এর গ্রাউন্ড ওয়াটার সার্কেল, বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তর (জিএসবি), বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন ইত্যাদি সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহ দেশের ভিতরে আর্সেনিক দূষণের প্রমাণ অনুসন্ধান করা শুরু করে। কয়েকটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান (এনজিও) এবং গবেষণা সংস্থাও আর্সেনিক সংক্রান্ত গবেষণায় সক্রিয় হয়ে ওঠে।
সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে আর্সেনিক আক্রান্ত রোগী শনাক্তকরণ এবং ভূগর্ভস্থ পানি বিশ্লেষণে নিপসম উল্লেখ্য যোগ্য অবদান রেখেছে। এনজিও সমূহের মধ্যে ঢাকা কমিউনিটি হাসপাতাল ভারতের এস.ও.ই.এস-এর সহযোগিতায় রোগী শনাক্তকরণ ও পানি পরীক্ষার উদ্দেশ্যে দেশের ৬১টি জেলায় জরিপ পরিচালনা করে। এ কাজে নিয়োজিত অন্যান্য এনজিওগুলি হচ্ছে ব্র্যাক, গ্রামীণ ব্যাংক, এনজিও ফোরাম, বি.সি.এ.এস ইত্যাদি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগ লন্ডনের ইউনিভার্সিটি কলেজ ও সুইডেনের রয়্যাল ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির সহযোগিতায় কাজ করে যাচ্ছে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের সহযোগিতায় একই লক্ষ্যে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়-এর পক্ষ থেকেও আর্সেনিকের ওপর গবেষণা পরিচালিত হচ্ছে। জাতিসংঘ শিশু তহবিল (ইউনিসেফ), বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, বিশ্ব ব্যাংক, আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) ইত্যাদির মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলি বাংলাদেশে আর্সেনিক দূষণ শনাক্তকরণ ও প্রশমনের ক্ষেত্রে সরকার ও এনজিওগুলিকে সক্রিয়ভাবে সহযোগিতা করছে। আর্সেনিকের ওপর কেন্দ্রীয়ভাবে উপাত্ত সংগ্রহ, বিশ্লেষণ, সংরক্ষণ ও দূষণ প্রশমনের কৌশল বাস্তবায়নের দায়িত্ব দিয়ে ‘বাংলাদেশ আর্সেনিক মিটিগেশন ওয়াটার সাপ্লাই প্রজেক্ট’ (BAMWSP) চালু করা হয়েছিল। বাংলাদেশে আর্সেনিক দূষণ সংক্রান্ত এযাবত সবচেয়ে ব্যাপক ও রীতিবদ্ধ জরিপটি পরিচালিত হয়েছে ১৯৯৮-৯৯ সালে ব্রিটিশ জিওলজিক্যাল সার্ভে এবং মট ম্যাকডোনাল্ড লিমিটেড-এর যৌথ সহযোগিতায় সরকারের জনস্বাস্থ্য ও প্রকৌশল অধিদপ্তর কর্তৃক।
ভূগর্ভস্থ পানিতে আর্সেনিক মাত্রা পরীক্ষার জন্য বাংলাদেশে সাধারণত দুটি পৃথক পদ্ধতি ব্যবহূত হচ্ছে। প্রথমটির নাম ‘ফিল্ড কিট মেথড’। এটি গুণগত থেকে আধা-পরিমাণগত ধরনের একটি পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে পরীক্ষিত পানিকে নিরাপদ ও অনিরাপদ - এ দুটি প্রকরণে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়। আর্সেনিক পরীক্ষার দ্বিতীয় পদ্ধতিটি হলো গবেষণাগারের বিশ্লেষণ। এটি সম্পূর্ণভাবেই পরিমাণগত এবং এতে ভূগর্ভস্থ পানিতে আর্সেনিকের সঠিক পরিমাণ জানা যায়। ১৯৯৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত ফিল্ড কিট ও ল্যাবরেটরি উভয়বিধ পদ্ধতিতেই ভূগর্ভস্থ পানির ব্যাপক নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে।
BAMWSP প্রকল্পের আওতায় দেশের ২৭০টি উপজেলার প্রায় ৫০ লাখ নলকূপ পরীক্ষা করা হয়েছে যার মধ্যে ২৭% নলকূপে বাংলাদেশ মান মাত্রার উপরে আর্সেনিক শনাক্ত করা হয়েছে। এ ছাড়া জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর দেশের অন্যান্য এলাকা প্রায় ১৯০টি উপজেলায় জরিপ করেছে। বর্তমানে সারাদেশের আর্সেনিক দূষণ মানচিত্র তৈরি করা হয়েছে যাতে দেখা যায় যে দেশের দক্ষিণভাগে আর্সেনিকের উপস্থিতি অনেক বেশি। তবে গ্রাম, ইউনিয়ন ও উপজেলা ভিত্তিক ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা যায় কোনো কোনো এলাকার শতভাগ নলকূপ আর্সেনিক দূষণ আক্রান্ত আবার কোনো কোনো এলাকায় শতভাগ দূষণমুক্ত।
বাংলাদেশের নলকূপগুলিতে আর্সেনিকের মাত্রা এবং সহনসীমা অতিক্রমকারী নলকূপের বণ্টন বিন্যাস বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন রকম। কিছু অঞ্চলে শতভাগ নমুনাতেই এ সীমা অতিক্রম ধরা পড়েছে, আবার কোনো কোনো অঞ্চলে একেবারেই অতিক্রম করে নি। সর্বোচ্চ দূষণযুক্ত জেলাগুলি হচ্ছে চাঁদপুর (৯০%), মুন্সিগঞ্জ (৮৩%), গোপালগঞ্জ (৭৯%), মাদারীপুর (৬৯%), নোয়াখালী (৬৯%), সাতক্ষীরা (৬৭%), কুমিল্লা (৬৫%), ফরিদপুর (৬৫%), শরিয়তপুর (৬৫%), মেহেরপুর (৬০%) ও বাগেরহাট (৬০%)। সবচেয়ে কম দূষণযুক্ত জেলাগুলি হচ্ছে ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, নীলফামারী, নাটোর, লালমনিরহাট, পটুয়াখালী ও বরগুনা। এসব জেলার কোথাও ভূগর্ভস্থ পানিতে আর্সেনিকের পরিমাণ সহনসীমা অতিক্রম করে নি। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের অর্ধেক অংশই আর্সেনিক দূষণযুক্ত, কিন্তু উত্তর-পূর্বে সামান্য কয়েকটি দূষণের ঘটনা জানা গেছে। উত্তরাংশ হয় দূষণমুক্ত অথবা কদাচিৎ দূষণ ঘটেছে। বিভিন্ন সংগঠনের মাঠ পর্যায় ও গবেষণাগারে পরীক্ষার ফলাফল থেকে সারা দেশে আর্সেনিক দূষণের এ সাধারণ চিত্রটি অংকন করা হয়েছে। তবে দূষণমুক্ত অঞ্চলেও দূষণযুক্ত কিছু কিছু স্থানীয় পকেটের অস্তিত্ব দেখা গেছে। বিভিন্ন জরিপ থেকে অনুমান করা হয় যে, দেশের প্রায় ৩ কোটি মানুষের পানীয় জলে উচ্চমাত্রার আর্সেনিক দূষণের ঝুঁকি রয়েছে। বাংলাদেশে ঢাকা কমিউনিটি হাসপাতাল, BAMWSP প্রকল্প ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর আর্সেনিক আক্রান্ত রোগী শনাক্তকরণ কাজ শুরু করে ১৯৯৫ সাল থেকে। বর্তমানে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে সারাদেশে প্রায় ৪০ হাজার আর্সেনিক আক্রান্ত রোগীর শনাক্ত করা হয়েছে।
বাংলাদেশের দূষণযুক্ত এলাকাগুলি মোটামুটিভাবে গাঙ্গেয় বদ্বীপ সমভূমি ও মেঘনার মোহনাজ সমভূমি অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত। পশ্চিমবঙ্গেও আর্সেনিক দূষণ ঊর্ধ-বদ্বীপীয় সমভূমিতেই সীমিত যা গাঙ্গেয় বদ্বীপ সমভূমির একটি অংশ। এ অঞ্চলের অবক্ষেপের ইতিহাস প্লাইসটোসিন যুগে সমুদ্রপৃষ্ঠের পরিবর্তন এবং সমুদ্রপৃষ্ঠ নেমে যাওয়ায় নদীর বাঁকে গড়ে ওঠা ঘন পলির স্তরক্রম দ্বারা প্রভাবিত।
বাংলাদেশে সমস্যাটি প্রথম যখন ধরা পড়ে, তখন আর্সেনিক দূষণের জন্য কয়েকটি মতবাদ প্রদান করা হয়েছিল। এগুলির মধ্যে মনুষ্যসৃষ্ট ও প্রাকৃতিক উভয় কারণই অন্তর্ভুক্ত ছিল। মনুষ্যসৃষ্ট কারণগুলির মধ্যে রাসায়নিক সারের ব্যবহার, কীটনাশক, বর্জ্যপদার্থ অবক্ষেপণ, আর্সেনিক যৌগ দিয়ে প্রক্রিয়াজাতকৃত কাঠের বৈদ্যুতিক খুঁটি ইত্যাদিকে এ দূষণের জন্য দায়ী করা হয়। অন্যদিকে, এস.ও.ই.এস পাইরাইট জারণ মতবাদকে বঙ্গীয় অববাহিকায় আর্সেনিক দূষণের প্রধান কার্যকারণ বলে চিহ্নিত করে এবং এ মতবাদ সাদরে গৃহীত হয়। কিন্তু ১৯৯৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকায় ঢাকা কমিউনিটি হাসপাতাল এবং এস.ও.ই.এস কর্তৃক আয়োজিত আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ঐকমত্য প্রকাশ করা হয় যে, দূষণের কারণ ভূতাত্ত্বিক, মনুষ্যসৃষ্ট নয়। একই সম্মেলনে আয়রন অক্সিহাইড্রক্সাইড বিজারণ মতবাদ (iron oxyhydroxide reduction hypothesis) নামে একটি বিকল্প মতবাদ উপস্থাপন করা হলে তা সাদরে গৃহীত হয়। বাংলাদেশে আর্সেনিক দূষণের সঙ্গে কৃষি সেচের জন্য ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন বা ভূগর্ভস্থ জলস্তর নিচে নেমে যাওয়ার প্রত্যক্ষ কোনো সম্পর্ক এখন পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যায় নি।
প্রশমন সরকারি, বেসরকারি ও আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহ বাংলাদেশে আর্সেনিক দূষণ প্রশমনের জন্য কাজ করে চলেছে। সরকার বিশ্বব্যাংক-এর আর্থিক সহায়তায় ‘বাংলাদেশ আর্সেনিক শোধিত জল সরবরাহ প্রকল্প’ (Bangladesh Arsenic Mitigation Water Supply Project) শীর্ষক একটি কর্মসূচি গ্রহণ করে, যা ২০০৮ পর্যন্ত চালু ছিল। পরবর্তী পর্যায়ে এ প্রকল্পটির নাম পরিবর্তন করে = করা হয়। BAMWSP প্রকল্প আর্সেনিক সমস্যা সমাধানে সফল না হলেও নলকূপ পরীক্ষা ও রোগী শনাক্তকরণে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করে।
আর্সেনিক সমস্যা সমাধানে সরকার ২০০৪ সালে জাতীয় আর্সেনিক নীতি ও প্রশনের পরিকল্পনা প্রণয়ন করে। উক্ত নীতি ও কর্মপরিকল্পনার আওতায় পানি সরবরাহ ও স্বাস্থ্য খাতে বিভিন্ন পরিকল্পনা নেয়া হয়। বিকল্প পানি সরবরাহের জন্য বিভিন্ন আর্সেনিক আক্রান্ত এলাকায় বিভিন্ন ভাবে নিরাপদে পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করছে। বর্তমানে প্রচলিত ব্যবস্থা সমূহ:
গার্হস্থ্য পর্যায়ে আর্সেনিক প্রতিরোধ গার্হস্থ্য পর্যায়ে খাবার পানিকে আর্সেনিকমুক্ত করতে কয়েকটি ভিন্ন ভিন্ন কৌশল উদ্ভাবন করা হয়েছে। যেমন ক্ষুদ্রাকার আর্সেনিক পরিস্রাবক যন্ত্র বা ফিল্টার। অতি প্রচলিত উদ্ভাবনগুলি হচ্ছে: তিন কলস প্রক্রিয়া, সাফি ফিল্টার, এস.ও.ই.এস ফিল্টার, দু বালতি পদ্ধতি, নিষ্ক্রিয় অবক্ষেপ (Passive sedimentation) ইত্যাদি। গার্হস্থ্য পর্যায়ে এ সব পদ্ধতির সাহায্যে খাবার পানি থেকে আর্সেনিক পরিশ্রুত করা হয়।
অতি অগভীর নলকূপ ও পাতকুয়া দেশের অধিকাংশ অঞ্চলে খুব কম গভীরতা বিশিষ্ট নলকূপ ও পাতকুয়াগুলি (১০ মিটারের কম গভীর) আর্সেনিক দূষণমুক্ত থাকতে দেখা গেছে এবং সে জন্যই অগভীর নলকূপ ও পাতকুয়াকে আর্সেনিকমুক্ত পানীয় জলের বিকল্প উৎস হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। অবশ্য এ অগভীর ভূগর্ভস্থ জলে সাধারণত জীবাণুঘটিত দূষণ ও নাইট্রেটের পরিমাণ বেশি থাকে।
পুকুর বালু ফিল্টার এ ধরনের ফিল্টারে পুকুরের পানি শোধন করা হয়। সংরক্ষিত একটি পুকুরের কাছে বালু ফিল্টার তৈরি করা হয় এবং এটি আর্সেনিক এবং জীবাণু উভয় প্রকারের দূষণ থেকে মুক্ত পানীয় জল প্রদানে সক্ষম। অবশ্য এটির রক্ষণাবেক্ষণ বেশ সমস্যাপূর্ণ।
বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ বৃষ্টির পানিকেও আর্সেনিকমুক্ত পানির একটি উৎস হিসেবে ভাবা হচ্ছে, অন্তত বর্ষা মৌসুমে। বৃষ্টির পানি পানীয় জল হিসেবে বড় মাটির পাত্রে বা ফেরো-সিমেন্ট জালায় সংরক্ষণ করে রাখা যায়।
গভীর ভূগর্ভস্থ জল অতিগভীর (১৫০ মি বা অধিক) নলকূপগুলির পানি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আর্সেনিকমুক্ত হতে দেখা গেছে, বিশেষ করে বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায়। তাই গভীরতর ভূগর্ভস্থ জল আর্সেনিকমুক্ত পানীয় জলের একটি নির্ভরযোগ্য দীর্ঘমেয়াদি উৎস হিসেবে চিহ্নিত।
বিশোধিত ভূ-পৃষ্ঠের জল ভূ-পৃষ্ঠের পানি স্বাভাবিক কারণেই প্রচুর পরিমাণে অণুজীবীয় দূষক সম্পৃক্ত থাকে। সুযোগ থাকলে ভূ-পৃষ্ঠের পানিকে শোধন করে পানীয় জল হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে।
আর্সেনিক বিশোধন কেন্দ্র পৌর এলাকায় যে সব স্থানে পাইপ লাইনের মাধ্যমে পানি সরবরাহের ব্যবস্থা রয়েছে, সেখানে আর্সেনিক বিশোধন কেন্দ্র নির্মাণ করা যেতে পারে। বাংলাদেশে মানিকগঞ্জ, মেহেরপুর ও সাতক্ষীরায় এধরনের কিছু স্থাপনা নির্মিত হয়েছে।
পল্লী এলাকায় পাই লাইনের মাধ্যমে পানি সরবরাহ: বর্তমানে দেশের বিভিন্ন আর্সেনিক আক্রান্ত গ্রামীণ এলাকায় পাইপ লাইনের মাধ্যমে পানি সরবরাহের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে মূলত ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করে এ সরবরাহ ব্যবস্থা গড়ে তোলা হচ্ছে।
ভূগর্ভস্থ পানিতে আর্সেনিকের দূষণ মানবজাতির জন্য কোনো নতুন স্বাস্থ্য সমস্যা নয়। তবে বাংলাদেশে সমস্যাটি নতুন এবং দূষণের উচ্চমাত্রাও ব্যতিক্রম। ঘনবসতির দেশ হওয়ায় সমস্যাটি আরও প্রকট আকার ধারণ করেছে। সবচেয়ে রক্ষণশীল হিসেবেও দেখা যায় যে, বাংলাদেশের প্রায় ৩ কোটি মানুষ আজ আর্সেনিক বিপর্যয়ের কবলে। এ সমস্যার নিরসন এবং এ বিরাট জনগোষ্ঠীর জন্য বিকল্প নিরাপদ পানীয় জলের ব্যবস্থা করা দুষ্কর। কোনো অঞ্চলকে জরুরি ভিত্তিতে বিবেচনায় নিতে হবে এবং কোনো অঞ্চলকে বাদ দেওয়া যাবে সেটা আর্সেনিক দূষণ অঞ্চলের মানচিত্র থেকেই পরিষ্কার বোঝা যায়। আর্সেনিক নিরসনের বেশ কিছু বিকল্প পদ্ধতি উপরে বর্ণিত হয়েছে, যেমন - গার্হস্থ্য ফিল্টার, কমিউনিটি ভিত্তিক আর্সেনিক বিশোধন প্লান্ট, গভীরতর নলকূপ স্থাপন, ভূ-পৃষ্ঠের পানি ব্যবহার ও বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ। সমগ্র দেশের জন্য কোনো একটি বিশেষ পদ্ধতি প্রয়োগযোগ্য নয়, বরং নিরাপদ পানীয় জলের সরবরাহ নিশ্চিত করতে বিভিন্ন অঞ্চলের জন্য ভিন্ন ভিন্ন কৌশল প্রয়োগ করা যেতে পারে। বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ সত্ত্বেও বাংলাদেশে আর্সেনিক সমস্যা একটি প্রধান জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে বিদ্যমান। এখনও উল্লেখ্য সংখ্যক লোক আর্সেনিকের ঝুঁকির মধ্যে বসবাস করছে।
আগ্নেয়, রূপান্তরিত ও পাললিক শিলায় আর্সেনিকের পরিমাণ ভিন্ন ভিন্ন। সাধারণত আগ্নেয় এবং রূপান্তরিত শিলার চেয়ে পাললিক শিলায় আর্সেনিক বেশি পরিমাণে উপস্থিত থাকে। পাললিক শিলায় আর্সেনিকের তীব্রতা ও সঞ্চিত হওয়ার ধরনের মধ্যে বেশ ভিন্নতা রয়েছে। অসামুদ্রিক কর্দমশিলায় আর্সেনিক সাধারণত কর্দম খনিজ দ্বারা বিশোষিত হয়। বেলেপাথর ও কার্বনেটে আর্সেনিকের পরিমাণ কম, গড়ে কিলোগ্রাম প্রতি ১ মিলিগ্রাম। অধিকাংশ জলব্যবস্থায় প্রলম্বিত ও নিম্নস্থ অবক্ষেপসমূহ বেশ উচ্চমাত্রার আর্সেনিক ধারণ করে। কয়লা ২,০০০ মিগ্রা/কিলোগ্রাম পর্যন্ত আর্সেনিক ধারণ করতে সক্ষম।
আগাছা ও কীটনাশক হিসেবে আর্সেনিকের প্রয়োগ আর্সেনিক দূষণের একটি প্রধান উৎস। উচ্চ চাপযুক্ত স্প্রের ব্যাপক ব্যবহার শুধু মাটি ও গাছপালার দূষণই ঘটায় না, পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের বাতাস ও ভূ-পৃষ্ঠস্থ পানিকেও দূষিত করে তোলে। অনেক ক্ষেত্রে আর্সেনিক ছিটানো পরিত্যক্ত তুলা ক্ষেত পোড়ালে বায়ু দূষণ ঘটে। বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কিছু অঞ্চলে এরকম ঘটতে দেখা গেছে। ভূ-পৃষ্ঠস্থ পানিতে আর্সেনিক দূষণের প্রধান প্রধান উৎস হচ্ছে গার্হস্থ্য ও কলকারখানার বর্জ্য পানি, কাঠের বৈদ্যুতিক খুঁটি, খনি থেকে অবর ধাতু (base metal) উত্তোলন ও নিষ্কাশন এবং দূষিত অ্যারোসলের প্রতিক্রিয়া।
আর্সেনিক দূষণ একটি Global Problem. পৃথিবীর সকল মহাদেশের ৫০টির মতো দেশে ভূগর্ভস্থ বা ভূপরিস্থ পানিতে উচ্চমাত্রার আর্সেনিক শনাক্ত করা হয়েছে। তাইওয়ানে প্রথম শনাক্তকরণের পর থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ক্রমান্বয়ে আর্সেনিক দূষণ শনাক্ত করা হয়েছে। সর্বাধিক দূষণ আক্রান্ত এলাকা হচ্ছে- ল্যাটিন আমেরিকা (আর্জেন্টিনা, চিলি, মেক্সিকো, নিকাবগুয়া ও অন্যান্য দেশ); দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া (ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ড, লাওস, মিয়ানমার) ও দক্ষিণ এশিয়া (বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, পাকিস্তান)। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, স্পেন, ইটালী, জার্মানি, যুক্তরাজ্য, চীন, ব্রাজিল, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, ইত্যাদি দেশে বিভিন্ন মাত্রার আর্সেনিক দূষণ রয়েছে। আক্রান্ত বা ঝুঁকিগ্রস্থ জনসংখ্যার হিসেবে বাংলাদেশ সর্বাধিক দূষণগ্রস্থ দেশ হিসেবে পরিগণিত হয়েছে।
খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ অব্দে কাঁসার শঙ্কর তৈরিতে আর্সেনিক যৌগ ব্যবহূত হতো। খ্রিস্টপূর্ব ৪০০ অব্দের আগে থেকে ওষুধ হিসেবে এর প্রচলন ছিল। কীটনাশকের যৌগ হিসেবে আর্সেনিকের ব্যবহার প্রাচীনকাল থেকেই লক্ষ্য করা যায়। আঙ্গুর ক্ষেতকে পোকার আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য সান্দারাচ (রিয়ালগার বা লোহিত আর্সেনিক সালফাইড) ব্যবহার করা হতো। চীনারা সম্ভবত দশ শতক থেকে আর্সেনিক যৌগকে কীটনাশক হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করে। মধ্যযুগেও এটি কৃষিতে ব্যাপক হারে প্রয়োগ করা হতো। ১৮৬৮ সালে একজন মার্কিন কৃষক কর্তৃক আলুর পোকা নিয়ন্ত্রণে প্যারিস গ্রিন (কপার অ্যাসিটো-আর্সেনাইট) আবিষ্কারের পর থেকে কৃষিতে কীটনাশক হিসেবে আর্সেনিকের প্রয়োগ ব্যাপক হয়ে ওঠে। প্যারিস গ্রিনের সাফল্য কীটনাশক হিসেবে লন্ডন পার্পলের (কিছু জৈব পদার্থের সঙ্গে ক্যালশিয়াম আর্সিনেট ও আর্সেনাইটের মিশ্রণ) পরীক্ষাকে উৎসাহিত করে এবং দ্রুত কৃষিতে এর প্রয়োগ শুরু হয়। পরবর্তী সময়ে আরও কয়েকটি আর্সেনিক যৌগ কীটনাশক হিসেবে প্রবর্তিত হয়। এর পর কিছু অজৈব আর্সেনিক যৌগের ছোটখাটো ব্যবহার শুরু হয় প্রধানত আগাছানাশক হিসেবে। কিন্তু বর্তমান কালে আগাছানাশক হিসেবে আর্সেনিক যৌগের ব্যবহার একেবারেই কমে এসেছে। সাম্প্রতিক অতীতে অবশ্য কাঠ সংরক্ষণে ক্রোমেটেড কপার আর্সিনেট ও অ্যামোনিয়াকল কপার আর্সিনেটের ব্যবহার খুবই চালু ছিল। অজৈব আর্সেনিক যৌগ ছাড়াও জৈব আর্সেনিক যৌগসমূহ যেমন: মনোসোডিয়াম মিথানো-আর্সোনেট (MSMA), ডাই-সোডিয়াম মিথানো-আর্সোনেট (DSMA), আর্সেনিক এসিড এবং ডাই-মিথিলারসনিক এসিডের ব্যবহার ১৯৭০ দশকের মাঝামাঝি থেকে বাড়তির দিকে এবং বর্তমানে পরিমাণের দিক থেকে এগুলি সবচেয়ে বেশি ব্যবহূত হচ্ছে।
আর্সেনিক দূষণ ভারতের পশ্চিমবঙ্গে আর্সেনিক দূষণ ধরা পড়ার পর থেকে বাংলাদেশের ভূগর্ভস্থ পানিতে বিশেষ করে পশ্চিমাঞ্চলীয় সীমান্ত জেলাসমূহে আর্সেনিক দূষণের আশঙ্কা দেখা দেয়। বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্য ও প্রকৌশল অধিদপ্তর ১৯৯৩ সালে নবাবগঞ্জ সদর (চাঁপাই নবাবগঞ্জ) উপজেলার বড়ঘরিয়া মৌজায় কয়েকটি কূপে পরীক্ষা চালিয়ে সর্বপ্রথম ভূগর্ভস্থ পানিতে আর্সেনিকের উপস্থিতি লক্ষ্য করে। ১৯৯৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগে (School of Environmental Sciences – SOES/ এস.ও.ই.এস) অনুষ্ঠিত একটি সেমিনারের পর বিষয়টি জনসমক্ষে আসে। এর পর থেকেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, জনস্বাস্থ্য ও প্রকৌশল অধিদপ্তর, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর প্রিভেনটিভ এন্ড সোশাল মেডিসিন (নিপসম), বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (বি.ডব্লিউ.ডি.বি)-এর গ্রাউন্ড ওয়াটার সার্কেল, বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তর (জিএসবি), বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন ইত্যাদি সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহ দেশের ভিতরে আর্সেনিক দূষণের প্রমাণ অনুসন্ধান করা শুরু করে। কয়েকটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান (এনজিও) এবং গবেষণা সংস্থাও আর্সেনিক সংক্রান্ত গবেষণায় সক্রিয় হয়ে ওঠে।
সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে আর্সেনিক আক্রান্ত রোগী শনাক্তকরণ এবং ভূগর্ভস্থ পানি বিশ্লেষণে নিপসম উল্লেখ্য যোগ্য অবদান রেখেছে। এনজিও সমূহের মধ্যে ঢাকা কমিউনিটি হাসপাতাল ভারতের এস.ও.ই.এস-এর সহযোগিতায় রোগী শনাক্তকরণ ও পানি পরীক্ষার উদ্দেশ্যে দেশের ৬১টি জেলায় জরিপ পরিচালনা করে। এ কাজে নিয়োজিত অন্যান্য এনজিওগুলি হচ্ছে ব্র্যাক, গ্রামীণ ব্যাংক, এনজিও ফোরাম, বি.সি.এ.এস ইত্যাদি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগ লন্ডনের ইউনিভার্সিটি কলেজ ও সুইডেনের রয়্যাল ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির সহযোগিতায় কাজ করে যাচ্ছে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের সহযোগিতায় একই লক্ষ্যে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়-এর পক্ষ থেকেও আর্সেনিকের ওপর গবেষণা পরিচালিত হচ্ছে। জাতিসংঘ শিশু তহবিল (ইউনিসেফ), বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, বিশ্ব ব্যাংক, আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) ইত্যাদির মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলি বাংলাদেশে আর্সেনিক দূষণ শনাক্তকরণ ও প্রশমনের ক্ষেত্রে সরকার ও এনজিওগুলিকে সক্রিয়ভাবে সহযোগিতা করছে। আর্সেনিকের ওপর কেন্দ্রীয়ভাবে উপাত্ত সংগ্রহ, বিশ্লেষণ, সংরক্ষণ ও দূষণ প্রশমনের কৌশল বাস্তবায়নের দায়িত্ব দিয়ে ‘বাংলাদেশ আর্সেনিক মিটিগেশন ওয়াটার সাপ্লাই প্রজেক্ট’ (BAMWSP) চালু করা হয়েছিল। বাংলাদেশে আর্সেনিক দূষণ সংক্রান্ত এযাবত সবচেয়ে ব্যাপক ও রীতিবদ্ধ জরিপটি পরিচালিত হয়েছে ১৯৯৮-৯৯ সালে ব্রিটিশ জিওলজিক্যাল সার্ভে এবং মট ম্যাকডোনাল্ড লিমিটেড-এর যৌথ সহযোগিতায় সরকারের জনস্বাস্থ্য ও প্রকৌশল অধিদপ্তর কর্তৃক।
ভূগর্ভস্থ পানিতে আর্সেনিক মাত্রা পরীক্ষার জন্য বাংলাদেশে সাধারণত দুটি পৃথক পদ্ধতি ব্যবহূত হচ্ছে। প্রথমটির নাম ‘ফিল্ড কিট মেথড’। এটি গুণগত থেকে আধা-পরিমাণগত ধরনের একটি পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে পরীক্ষিত পানিকে নিরাপদ ও অনিরাপদ - এ দুটি প্রকরণে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়। আর্সেনিক পরীক্ষার দ্বিতীয় পদ্ধতিটি হলো গবেষণাগারের বিশ্লেষণ। এটি সম্পূর্ণভাবেই পরিমাণগত এবং এতে ভূগর্ভস্থ পানিতে আর্সেনিকের সঠিক পরিমাণ জানা যায়। ১৯৯৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত ফিল্ড কিট ও ল্যাবরেটরি উভয়বিধ পদ্ধতিতেই ভূগর্ভস্থ পানির ব্যাপক নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে।
BAMWSP প্রকল্পের আওতায় দেশের ২৭০টি উপজেলার প্রায় ৫০ লাখ নলকূপ পরীক্ষা করা হয়েছে যার মধ্যে ২৭% নলকূপে বাংলাদেশ মান মাত্রার উপরে আর্সেনিক শনাক্ত করা হয়েছে। এ ছাড়া জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর দেশের অন্যান্য এলাকা প্রায় ১৯০টি উপজেলায় জরিপ করেছে। বর্তমানে সারাদেশের আর্সেনিক দূষণ মানচিত্র তৈরি করা হয়েছে যাতে দেখা যায় যে দেশের দক্ষিণভাগে আর্সেনিকের উপস্থিতি অনেক বেশি। তবে গ্রাম, ইউনিয়ন ও উপজেলা ভিত্তিক ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা যায় কোনো কোনো এলাকার শতভাগ নলকূপ আর্সেনিক দূষণ আক্রান্ত আবার কোনো কোনো এলাকায় শতভাগ দূষণমুক্ত।
বাংলাদেশের নলকূপগুলিতে আর্সেনিকের মাত্রা এবং সহনসীমা অতিক্রমকারী নলকূপের বণ্টন বিন্যাস বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন রকম। কিছু অঞ্চলে শতভাগ নমুনাতেই এ সীমা অতিক্রম ধরা পড়েছে, আবার কোনো কোনো অঞ্চলে একেবারেই অতিক্রম করে নি। সর্বোচ্চ দূষণযুক্ত জেলাগুলি হচ্ছে চাঁদপুর (৯০%), মুন্সিগঞ্জ (৮৩%), গোপালগঞ্জ (৭৯%), মাদারীপুর (৬৯%), নোয়াখালী (৬৯%), সাতক্ষীরা (৬৭%), কুমিল্লা (৬৫%), ফরিদপুর (৬৫%), শরিয়তপুর (৬৫%), মেহেরপুর (৬০%) ও বাগেরহাট (৬০%)। সবচেয়ে কম দূষণযুক্ত জেলাগুলি হচ্ছে ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, নীলফামারী, নাটোর, লালমনিরহাট, পটুয়াখালী ও বরগুনা। এসব জেলার কোথাও ভূগর্ভস্থ পানিতে আর্সেনিকের পরিমাণ সহনসীমা অতিক্রম করে নি। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের অর্ধেক অংশই আর্সেনিক দূষণযুক্ত, কিন্তু উত্তর-পূর্বে সামান্য কয়েকটি দূষণের ঘটনা জানা গেছে। উত্তরাংশ হয় দূষণমুক্ত অথবা কদাচিৎ দূষণ ঘটেছে। বিভিন্ন সংগঠনের মাঠ পর্যায় ও গবেষণাগারে পরীক্ষার ফলাফল থেকে সারা দেশে আর্সেনিক দূষণের এ সাধারণ চিত্রটি অংকন করা হয়েছে। তবে দূষণমুক্ত অঞ্চলেও দূষণযুক্ত কিছু কিছু স্থানীয় পকেটের অস্তিত্ব দেখা গেছে। বিভিন্ন জরিপ থেকে অনুমান করা হয় যে, দেশের প্রায় ৩ কোটি মানুষের পানীয় জলে উচ্চমাত্রার আর্সেনিক দূষণের ঝুঁকি রয়েছে। বাংলাদেশে ঢাকা কমিউনিটি হাসপাতাল, BAMWSP প্রকল্প ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর আর্সেনিক আক্রান্ত রোগী শনাক্তকরণ কাজ শুরু করে ১৯৯৫ সাল থেকে। বর্তমানে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে সারাদেশে প্রায় ৪০ হাজার আর্সেনিক আক্রান্ত রোগীর শনাক্ত করা হয়েছে।
বাংলাদেশের দূষণযুক্ত এলাকাগুলি মোটামুটিভাবে গাঙ্গেয় বদ্বীপ সমভূমি ও মেঘনার মোহনাজ সমভূমি অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত। পশ্চিমবঙ্গেও আর্সেনিক দূষণ ঊর্ধ-বদ্বীপীয় সমভূমিতেই সীমিত যা গাঙ্গেয় বদ্বীপ সমভূমির একটি অংশ। এ অঞ্চলের অবক্ষেপের ইতিহাস প্লাইসটোসিন যুগে সমুদ্রপৃষ্ঠের পরিবর্তন এবং সমুদ্রপৃষ্ঠ নেমে যাওয়ায় নদীর বাঁকে গড়ে ওঠা ঘন পলির স্তরক্রম দ্বারা প্রভাবিত।
বাংলাদেশে সমস্যাটি প্রথম যখন ধরা পড়ে, তখন আর্সেনিক দূষণের জন্য কয়েকটি মতবাদ প্রদান করা হয়েছিল। এগুলির মধ্যে মনুষ্যসৃষ্ট ও প্রাকৃতিক উভয় কারণই অন্তর্ভুক্ত ছিল। মনুষ্যসৃষ্ট কারণগুলির মধ্যে রাসায়নিক সারের ব্যবহার, কীটনাশক, বর্জ্যপদার্থ অবক্ষেপণ, আর্সেনিক যৌগ দিয়ে প্রক্রিয়াজাতকৃত কাঠের বৈদ্যুতিক খুঁটি ইত্যাদিকে এ দূষণের জন্য দায়ী করা হয়। অন্যদিকে, এস.ও.ই.এস পাইরাইট জারণ মতবাদকে বঙ্গীয় অববাহিকায় আর্সেনিক দূষণের প্রধান কার্যকারণ বলে চিহ্নিত করে এবং এ মতবাদ সাদরে গৃহীত হয়। কিন্তু ১৯৯৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকায় ঢাকা কমিউনিটি হাসপাতাল এবং এস.ও.ই.এস কর্তৃক আয়োজিত আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ঐকমত্য প্রকাশ করা হয় যে, দূষণের কারণ ভূতাত্ত্বিক, মনুষ্যসৃষ্ট নয়। একই সম্মেলনে আয়রন অক্সিহাইড্রক্সাইড বিজারণ মতবাদ (iron oxyhydroxide reduction hypothesis) নামে একটি বিকল্প মতবাদ উপস্থাপন করা হলে তা সাদরে গৃহীত হয়। বাংলাদেশে আর্সেনিক দূষণের সঙ্গে কৃষি সেচের জন্য ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন বা ভূগর্ভস্থ জলস্তর নিচে নেমে যাওয়ার প্রত্যক্ষ কোনো সম্পর্ক এখন পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যায় নি।
প্রশমন সরকারি, বেসরকারি ও আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহ বাংলাদেশে আর্সেনিক দূষণ প্রশমনের জন্য কাজ করে চলেছে। সরকার বিশ্বব্যাংক-এর আর্থিক সহায়তায় ‘বাংলাদেশ আর্সেনিক শোধিত জল সরবরাহ প্রকল্প’ (Bangladesh Arsenic Mitigation Water Supply Project) শীর্ষক একটি কর্মসূচি গ্রহণ করে, যা ২০০৮ পর্যন্ত চালু ছিল। পরবর্তী পর্যায়ে এ প্রকল্পটির নাম পরিবর্তন করে = করা হয়। BAMWSP প্রকল্প আর্সেনিক সমস্যা সমাধানে সফল না হলেও নলকূপ পরীক্ষা ও রোগী শনাক্তকরণে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করে।
আর্সেনিক সমস্যা সমাধানে সরকার ২০০৪ সালে জাতীয় আর্সেনিক নীতি ও প্রশনের পরিকল্পনা প্রণয়ন করে। উক্ত নীতি ও কর্মপরিকল্পনার আওতায় পানি সরবরাহ ও স্বাস্থ্য খাতে বিভিন্ন পরিকল্পনা নেয়া হয়। বিকল্প পানি সরবরাহের জন্য বিভিন্ন আর্সেনিক আক্রান্ত এলাকায় বিভিন্ন ভাবে নিরাপদে পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করছে। বর্তমানে প্রচলিত ব্যবস্থা সমূহ:
গার্হস্থ্য পর্যায়ে আর্সেনিক প্রতিরোধ গার্হস্থ্য পর্যায়ে খাবার পানিকে আর্সেনিকমুক্ত করতে কয়েকটি ভিন্ন ভিন্ন কৌশল উদ্ভাবন করা হয়েছে। যেমন ক্ষুদ্রাকার আর্সেনিক পরিস্রাবক যন্ত্র বা ফিল্টার। অতি প্রচলিত উদ্ভাবনগুলি হচ্ছে: তিন কলস প্রক্রিয়া, সাফি ফিল্টার, এস.ও.ই.এস ফিল্টার, দু বালতি পদ্ধতি, নিষ্ক্রিয় অবক্ষেপ (Passive sedimentation) ইত্যাদি। গার্হস্থ্য পর্যায়ে এ সব পদ্ধতির সাহায্যে খাবার পানি থেকে আর্সেনিক পরিশ্রুত করা হয়।
অতি অগভীর নলকূপ ও পাতকুয়া দেশের অধিকাংশ অঞ্চলে খুব কম গভীরতা বিশিষ্ট নলকূপ ও পাতকুয়াগুলি (১০ মিটারের কম গভীর) আর্সেনিক দূষণমুক্ত থাকতে দেখা গেছে এবং সে জন্যই অগভীর নলকূপ ও পাতকুয়াকে আর্সেনিকমুক্ত পানীয় জলের বিকল্প উৎস হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। অবশ্য এ অগভীর ভূগর্ভস্থ জলে সাধারণত জীবাণুঘটিত দূষণ ও নাইট্রেটের পরিমাণ বেশি থাকে।
পুকুর বালু ফিল্টার এ ধরনের ফিল্টারে পুকুরের পানি শোধন করা হয়। সংরক্ষিত একটি পুকুরের কাছে বালু ফিল্টার তৈরি করা হয় এবং এটি আর্সেনিক এবং জীবাণু উভয় প্রকারের দূষণ থেকে মুক্ত পানীয় জল প্রদানে সক্ষম। অবশ্য এটির রক্ষণাবেক্ষণ বেশ সমস্যাপূর্ণ।
বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ বৃষ্টির পানিকেও আর্সেনিকমুক্ত পানির একটি উৎস হিসেবে ভাবা হচ্ছে, অন্তত বর্ষা মৌসুমে। বৃষ্টির পানি পানীয় জল হিসেবে বড় মাটির পাত্রে বা ফেরো-সিমেন্ট জালায় সংরক্ষণ করে রাখা যায়।
গভীর ভূগর্ভস্থ জল অতিগভীর (১৫০ মি বা অধিক) নলকূপগুলির পানি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আর্সেনিকমুক্ত হতে দেখা গেছে, বিশেষ করে বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায়। তাই গভীরতর ভূগর্ভস্থ জল আর্সেনিকমুক্ত পানীয় জলের একটি নির্ভরযোগ্য দীর্ঘমেয়াদি উৎস হিসেবে চিহ্নিত।
বিশোধিত ভূ-পৃষ্ঠের জল ভূ-পৃষ্ঠের পানি স্বাভাবিক কারণেই প্রচুর পরিমাণে অণুজীবীয় দূষক সম্পৃক্ত থাকে। সুযোগ থাকলে ভূ-পৃষ্ঠের পানিকে শোধন করে পানীয় জল হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে।
আর্সেনিক বিশোধন কেন্দ্র পৌর এলাকায় যে সব স্থানে পাইপ লাইনের মাধ্যমে পানি সরবরাহের ব্যবস্থা রয়েছে, সেখানে আর্সেনিক বিশোধন কেন্দ্র নির্মাণ করা যেতে পারে। বাংলাদেশে মানিকগঞ্জ, মেহেরপুর ও সাতক্ষীরায় এধরনের কিছু স্থাপনা নির্মিত হয়েছে।
পল্লী এলাকায় পাই লাইনের মাধ্যমে পানি সরবরাহ: বর্তমানে দেশের বিভিন্ন আর্সেনিক আক্রান্ত গ্রামীণ এলাকায় পাইপ লাইনের মাধ্যমে পানি সরবরাহের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে মূলত ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করে এ সরবরাহ ব্যবস্থা গড়ে তোলা হচ্ছে।
ভূগর্ভস্থ পানিতে আর্সেনিকের দূষণ মানবজাতির জন্য কোনো নতুন স্বাস্থ্য সমস্যা নয়। তবে বাংলাদেশে সমস্যাটি নতুন এবং দূষণের উচ্চমাত্রাও ব্যতিক্রম। ঘনবসতির দেশ হওয়ায় সমস্যাটি আরও প্রকট আকার ধারণ করেছে। সবচেয়ে রক্ষণশীল হিসেবেও দেখা যায় যে, বাংলাদেশের প্রায় ৩ কোটি মানুষ আজ আর্সেনিক বিপর্যয়ের কবলে। এ সমস্যার নিরসন এবং এ বিরাট জনগোষ্ঠীর জন্য বিকল্প নিরাপদ পানীয় জলের ব্যবস্থা করা দুষ্কর। কোনো অঞ্চলকে জরুরি ভিত্তিতে বিবেচনায় নিতে হবে এবং কোনো অঞ্চলকে বাদ দেওয়া যাবে সেটা আর্সেনিক দূষণ অঞ্চলের মানচিত্র থেকেই পরিষ্কার বোঝা যায়। আর্সেনিক নিরসনের বেশ কিছু বিকল্প পদ্ধতি উপরে বর্ণিত হয়েছে, যেমন - গার্হস্থ্য ফিল্টার, কমিউনিটি ভিত্তিক আর্সেনিক বিশোধন প্লান্ট, গভীরতর নলকূপ স্থাপন, ভূ-পৃষ্ঠের পানি ব্যবহার ও বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ। সমগ্র দেশের জন্য কোনো একটি বিশেষ পদ্ধতি প্রয়োগযোগ্য নয়, বরং নিরাপদ পানীয় জলের সরবরাহ নিশ্চিত করতে বিভিন্ন অঞ্চলের জন্য ভিন্ন ভিন্ন কৌশল প্রয়োগ করা যেতে পারে। বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ সত্ত্বেও বাংলাদেশে আর্সেনিক সমস্যা একটি প্রধান জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে বিদ্যমান। এখনও উল্লেখ্য সংখ্যক লোক আর্সেনিকের ঝুঁকির মধ্যে বসবাস করছে।