দীর্ঘদিন একনাগাড়ে বিস্তীর্ণ স্থলভাগের প্লাবনকে বন্যা বলা হয়। এটি একটি
ক্রমপুঞ্জিত জলবায়ুসম্পর্কিত চরম ঘটনা। বৃষ্টিজনিত কারণে (বা যুগপৎ বৃষ্টি
এবং নদী বাঁধ থেকে অতিরিক্ত পানি মুক্ত করার ফলে) নদীতে প্রবাহিত অতিরিক্ত
পানি পাড় ছাপিয়ে নি¤œ অববাহিকার বিস্তীর্ণ অঞ্চলকে প্লাবিত করে বা কখনো
কখনো সাইক্লোনজনিত সামুদ্রিক জলোচ্ছ¡াস উপক‚লের বিস্তীর্ণ নিচু অঞ্চলকে
প্লাবিত করে। উল্লেখ্য যে, পৃথিবীর মোট ভৌগোলিক অঞ্চলের ৩.৫ শতাংশ
বন্যাপ্রবণ। পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার ১৬.৫ শতাংশ বন্যাপ্রবণ অঞ্চলে বাস করে।
বন্যার কারণ: প্রাকৃতিক এবং মনুষ্যসৃষ্ট উভয় কারণেই বন্যা হতে পারে। বন্যার প্রাকৃতিক এবং মনুষ্যসৃষ্ট কারণ সংক্ষেপে আলোচনা করা হল।
বন্যার প্রাকৃতিক কারণ:
ক) দীর্ঘস্থায়ী অতিবর্ষণ: মৌসুমী জলবায়ুর প্রভাবে বর্ষাঋতুতে কোন নদীর উচ্চ-অববাহিকায় দীর্ঘস্থায়ী অতিবর্ষণে ঐ নদীর নি¤œ-অববাহিকায় বন্যা দেখা দিতে পারে। এক্ষেত্রে নি¤œ অববাহিকায় নদী প্রণালী অতিরিক্ত পানি ধরে রাখতে পারে না। ফলে পাড় ছাপিয়ে উপচে পড়া পানি নি¤œ-অববাহিকার সন্নিকটস্থ সমতল ভ‚মিকে প্লাবিত করে।
খ) নদীর সর্পিল গতিপথ: নদীর সর্পিল বা তরঙ্গায়িত গতিপথ বন্যার অন্যতম কারণ। সর্পিল গতিপথ যুক্ত নদীতে পানির স্বাভাবিক অপসারণ বাধাপ্রাপ্ত হয়। ফলে নদী প্রণালীতে পানি দাঁড়িয়ে থাকে। এই অবস্থায় দীর্ঘস্থায়ী অতিবর্ষণে নদী প্রণালীতে পানি ক্রমপুঞ্জিভূত হয় এবং একটি সময়ে অতিরিক্ত পানি নদীর পাড় ছাপিয়ে সর্পিল গতিপথের সন্নিকটস্থ অঞ্চলকে প্লাবিত করে।
গ) নদীর স্বাভাবিক প্রবাহে প্রতিবন্ধকতা: ভ‚মিকম্প বা অন্যান্য প্রাকৃতিক কারণে ধস্ নেমে নদীতে পানির স্বাভাবিক মুক্ত প্রবাহে বাধার সৃষ্টি হলে বন্যা প্ররোচিত হতে পারে। কারণ ধস্জনিত বাধা দূরীকরণের ফলে নদীর নি¤œ অববাহিকায় ফ্ল্যাশ-ফ্লাড সৃষ্টি হতে পারে।
ঘ) বিস্তৃত বন্যাপ্রবণ সমতলভ‚মি: নদীর গতিপথে বিস্তৃত বন্যাপ্রবণ সমতলভ‚মিতে বন্যার তীব্রতা এবং বিস্তারকে বৃদ্ধি করে।
ঙ) নদী প্রণালীর ঢাল বা নতির পরিবর্তন: পর্বতের পাদদেশীয় ঢাল এবং সমতলের উচ্চপ্রান্তের মধ্যবর্তী নদী প্রণালীর নতির হঠাৎ পরিবর্তন বন্যা প্ররোচিত করে।
চ) সাইক্লোন: যুগপৎ মুষলধারে বৃষ্টি এবং নি¤œচাপ বা ডিপ্রেসানজনিত জলোচ্ছ¡াসে উপক‚লবর্তী নিচু অঞ্চল প্লাবিত হতে পারে।
ছ) হিমালয়ের শীর্ষে তুষারের গলন: প্রবল বর্ষণ ব্যতিরেকে হিমালয়ের শীর্ষে সঞ্চিত বরফের বেশিমাত্রায় গলন বন্যার অন্যতম কারণ।
বন্যার মনুষ্যসৃষ্ট কারণ:
ক) নদী প্রণালীর পরিবর্তন: নদী প্রণালীর কৃত্রিম পরিবর্তন বন্যাকে প্ররোচিত করে। পানিবিদ্যুৎ উৎপাদন এবং পানিসেচের কারণে নদী প্রণালীতে বাঁধ এবং বিজার্ভার নির্মিত হলে নদীর নি¤œ অববাহিকায় বন্যা দেখা দিতে পারে। বর্ষাকালে অতিবর্ষণ এবং বাঁধ বা রিজার্ভার থেকে পানিনির্গমন যদি যুগপৎ ঘটে তাহলে নির্গত প্রবাহের আধিক্যের কারণে নদীর নি¤œ অববাহিকায় বন্যা সৃষ্টি হতে পারে। এছাড়া নদী প্রণালীতে বাঁধ দিয়ে এবং খাল কেটে নদীকে ভিন্নমুখী করলেও ভিন্নমুখ নদী সন্নিকটস্থ সমতলে বন্যা ঘটাতে পারে।
খ) নদীগর্ভে পলিসঞ্চয়: নদীগর্ভে পলিসঞ্চিত হলে বন্যা প্ররোচিত হয়। অতিবর্ষণে তীর পৃষ্ঠীয় প্রবাহের দ্বারা শীর্ষ-মৃত্তিকা ক্ষয়িত হয়ে নদীগর্ভে জমা হয়। নদীগর্ভে সঞ্চিত শীর্ষ মৃত্তিকাকে ‘পলি’ বলা হয়। এইভাবে নদীগর্ভে পলির ক্রমসঞ্চয়ে নদীর নাব্য হ্রাস পায়। ফলে, বর্ষাকালে অতিবর্ষণজনিত নদীপ্রণালী ধরে রাখতে সক্ষম হয় না। এমতাবস্থায় নদীক‚ল উপছিয়ে যাওয়া পানি নদীর উভয় পার্শ্বের সমতলকে প্লাবিত করে। এইভাবে নদীগর্ভে পলিসঞ্চয়জনিত কারণে নদীর নাব্য হ্রাস বন্যার তীব্রতা এবং বিস্তারকে বহুলাংশে বৃদ্ধি করে। মৃত্তিকা ক্ষয়ের মুনষ্যসৃষ্ট কারণগুলি উল্লেখ করা হলো:
যথাযথ নয় এমন কৃষিরীতি, যথা: ১. উৎপাদন বৃদ্ধিকারক শস্যের চাষ (অর্থাৎ পর্যায়ক্রমিক শস্য বপন না করা। ২. ন্যূনতম অঞ্চল ভ‚মিকর্ষণ এবং ঢালচিহ্ন বরাবর হলকর্ষণরীতি অনুসরণ না করা। ৩. মৃত্তিকা ক্ষয়প্রবণ প্রান্তীয় ভ‚মিতে (যথা পাহাড়ের খাড়া ঢালে) চাষাবাদ এবং মৃত্তিকা ক্ষয়প্রবণ জমিতে গবাদিপশু প্রতিপালন। ৪. শিল্পাপয়ন, নগরায়ণ এবং ৫. কৃষ্টিতে জমি সরবরাহ করার জন্য অরণ্যনিধন। তৃণভ‚মির ভুল পরিচালন।
যথাযথ নয় এমন শিল্পায়ন এবং নগরায়ণ।
(রাস্তাঘাটা, পাকাবাড়ী, কংক্রিট ফুটপাথ এবং সিমেন্ট বাঁধানো অঙ্গন বা বাড়ীর উঠান ইত্যাদি বৃষ্টিজনিত সঞ্চিত পৃষ্ঠীয় পানিকে মৃত্তিকায় অনুপ্রবেশে বা চুইয়ে যাওয়াতে বাধা দান করে। এই কারণে পৃষ্ঠীয় প্রবাহ তীব্রতর হয়। এই তীব্র পৃষ্ঠীয় প্রবাহ যখন অনাবৃত মৃত্তিকার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয় তখন শীর্ষ-মৃত্তিকা ক্ষয়ে যায়।)
নদীপার্শ্বস্থ প্রাকৃতিক ভৌত পরিবেশের বিনাশ: অধিকাংশ উন্নয়নশীল দেশে, বিশেষত বাংলাদেশে, জনসংখ্যার চাপে নদী পার্শ্বস্থ প্রাকৃতিক ভৌত পরিবেশ ক্রমশঃ ধ্বংস হচ্ছে। নদীর বাঁধ, বন্যা প্রাচীর এবং বন্যাপ্রবণ নিচু অঞ্চলে অবৈধভাবে জনবসতি গড়ে ওঠায় নদী প্রণালী ক্রমসঙ্কুচিত হচ্ছে। এছাড়া পৌরসংস্থার জঞ্জাল এবং নর্দমা নির্গত আবর্জনার প্রভাবে নদীগর্ভ ক্রমশ ভরাট হচ্ছে, ফলে নদী প্রণালীর নাব্য হ্রাস পাচ্ছে। এইসব কারণে নদীপার্শ্বস্থ প্রাকৃতিক ভৌত পরিবেশ ধ্বংস হওয়ায় বর্ষাকালে নদীতে বন্যা প্ররোচিত হচ্ছে।
বন্যার সর্বনাশা প্রভাব:
বন্যার ফলে মানুষ এবং মানব সম্পদের অপরিমেয় ক্ষতি হয়। ক্ষতির প্রকৃতি অতিসংক্ষেপে উল্লেখ করা হলো:
ক) বন্যার করাল গ্রাসে অসংখ্য মানুষের মৃত্যু হয় (যথা: পানিতে ডুবে, রোগের আক্রমণে, খাদ্যের অভাবে, সাপের কামড়ে, বাড়ী-ঘর ধসে গিয়ে এবং বাজ পড়ে)।
খ) মাটির তৈরি বাড়ী ধ্বংস হয়, ভ‚তল যোগাযোগ বিনষ্ট হয় এবং পানি ও বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়।
গ) কৃষিজাত শস্য বিনষ্ট হয়।
ঘ) অসংখ্য বন্য এবং গৃহপালিত প্রাণী ও উদ্ভিদ মারা যায়।
ঙ) বহুলাংশে স্থলজ বাস্তুতন্ত্র বিনষ্ট হয় এবং জলজ বাস্তুতন্ত্রের অনভিপ্রেত পরিবর্তন ঘটে।
চ) উর্বর জমিতে বন্যাজনিত বালি সঞ্চয়ে জমির উৎপাদনশীলতা হ্রাস পায় (যদিও সঞ্চিত পলি অনেক ক্ষেত্রে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করে)।
এছাড়া বন্যাক্লিষ্ট মানুষের চিকিৎসা, খাদ্য ও বস্ত্র সরবরাহ, বাড়ী তৈরির অনুদান, রাস্তাঘাট পুননির্মাণ, বিদ্যুৎ ও জলসরবরাহের ব্যবস্থায় পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং অন্যান্য যোগাযোগ ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা প্রভৃতির কারণে আর্থিক ক্ষতি হয়।
বন্যা নিয়ন্ত্রণ:
বন্যা প্রাকৃতিক দুর্ঘটনা হলেও কয়েকটি উপায়ে এর তীব্রতা এবং বিস্তার নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে। বন্যা নিয়ন্ত্রণের কয়েকটি উপায় সংক্ষেপে আলোচনা করা হল:
ক) বাঁধ থেকে পানি নির্গত করার পূর্বে পূর্বাভাস এবং বিপদ সঙ্কেত দেওয়া উচিত। এর ফলে মানুষ যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করার সময় পেতে পারে। এছাড়া সাইক্লোন সৃষ্ট অতিবৃষ্টির সম্ভাবনা সম্পর্কে পূর্বাভাস দেওয়ার জন্য আধুনিক পূর্বাভাস ও বিপদ সঙ্কেত জ্ঞাপক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। এতে যুগপৎ সংঘটিত বৃষ্টি এবং বাঁধ থেকে পানি নির্গমনজনিত বিপদ এড়ানো যায়।
খ) নদীর প্রবাহিত পানিকে মূল প্রণালীতে সীমাবদ্ধ রাখার জন্য নদীর উভয় পার্শ্বে মাটি, পাথর বা কংক্রিট দিয়ে বাঁধ নির্মাণ করা বা বন্যা-প্রাচীর গড়ে তোলা উচিৎ।
বৃষ্টির সময় পৃষ্ঠীয়-প্রবাহের তীব্রতা হ্রাস করার জন্য অনাবৃত পাহাড়িয়া অঞ্চলে বনসৃজন, পুনঃবনসৃজনের মাধ্যমে উদ্ভিদ আচ্ছাদন সৃষ্টি করা উচিত।
উদ্ভিদ আচ্ছাদন মৃত্তিকায় পানির অনুপ্রবেশ বৃদ্ধি করে, ফলে পৃষ্ঠীয় প্রবাহের তীব্রতা হ্রাস পায় (এবং পরোক্ষভাবে বন্যার আশঙ্কা হ্রাস পায়) এছাড়া আচ্ছাদন সৃজনের মাধ্যমে মৃত্তিকার ক্ষয়রোধ করা যায়।
সর্পিল গতিপথযুক্ত নদীতে বন্যা হ্রাস বা রোধ করার জন্য গতিপথের সর্পিল ফাঁস অংশকে কৃত্রিম উপায়ে (মাটি কেটে) অবক্র বা ঋজু করা প্রয়োজন। পানি এই ঋজু প্রণালীর মাধ্যমে সর্পিল প্রণালীর তুলনায় অপেক্ষাকৃত বেশি গতিবেগ নিষ্কাশিত হতে পারে। ফলে সর্পিল বন্যা-সমতলে বন্যার তীব্রতা ও বিস্তার অনেকটা কমে যায়। যদিও তৃতীয় বিশ্বে এবং উন্নয়নশীল দেশে এই পদ্ধতিতে প্রয়োগ করা সম্ভব নয়, কারণ এই উপায়ে বন্যা হ্রাসে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন।
বন্যার তীব্রতা ও বিস্তার হ্রাস করার জন্য নদীর গতিপথে অসংখ্য বন্যা নিয়ন্ত্রক রিজার্ভার তৈরি করা উচিত। এতে নদী প্রণালীর মাধ্যমে পানির নিষ্কাশন হ্রাস করা যায়। এছাড়া রিজার্ভারে সঞ্চিত পানি সেচের কাজে এবং জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের কাজে লাগানো।
নদী প্রণালীতে পানিধারণ ক্ষমতা বা নাব্যতা বৃদ্ধি করে বন্যার তীব্রতা ও বিস্তার হ্রাস করা যায়। নাব্যতা বৃদ্ধি দু’ভাবে করা যায়: নদীগর্ভ থেকে সঞ্চিত পলি অপসারণ করে (এই পদ্ধতি অত্যধিক ব্যয়বহুল) বা পলিসঞ্চয় রোধ করা যেতে পারে। মৃত্তিকার ক্ষয় হার হ্রাস করে। নি¤œবর্ণিত উপায়ে মৃত্তিকা-ক্ষয় হ্রাস করা যেতে পারে:
পর্যায়ক্রমিক শস্য বপন, প্রান্তীয় জমিতে চাষাবাদ নিয়ন্ত্রণ, ঢালচিহ্ন বরাবর হলকর্ষণ, ন্যূনতম অঞ্চলে ভ‚মিকর্ষণ, পশুপালন নিয়ন্ত্রণ, আংশিক বা অনুর্বর জমিতে বনসৃজন বা পুনঃবনসৃজন, তৃণভ‚মি এবং আচ্ছাদিত জমির যথাযথ পরিচালন, পরিকল্পিত নগরায়ণ এবং শিল্পায়ন।
নদীপ্রণালীতে বর্দ্ধিত নির্গত পানিপ্রবাহকে উঁচু বাঁধ দিয়ে ঘেরা নিচু সমতলে (যেখানে কৃষিজমি এবং জনবসতি নেই) বা কৃত্রিম উপায়ে খনন করা খালে ভিন্নমুখী করে বন্যার তীব্রতাকে হ্রাস করা যায়।
বন্যার কারণ: প্রাকৃতিক এবং মনুষ্যসৃষ্ট উভয় কারণেই বন্যা হতে পারে। বন্যার প্রাকৃতিক এবং মনুষ্যসৃষ্ট কারণ সংক্ষেপে আলোচনা করা হল।
বন্যার প্রাকৃতিক কারণ:
ক) দীর্ঘস্থায়ী অতিবর্ষণ: মৌসুমী জলবায়ুর প্রভাবে বর্ষাঋতুতে কোন নদীর উচ্চ-অববাহিকায় দীর্ঘস্থায়ী অতিবর্ষণে ঐ নদীর নি¤œ-অববাহিকায় বন্যা দেখা দিতে পারে। এক্ষেত্রে নি¤œ অববাহিকায় নদী প্রণালী অতিরিক্ত পানি ধরে রাখতে পারে না। ফলে পাড় ছাপিয়ে উপচে পড়া পানি নি¤œ-অববাহিকার সন্নিকটস্থ সমতল ভ‚মিকে প্লাবিত করে।
খ) নদীর সর্পিল গতিপথ: নদীর সর্পিল বা তরঙ্গায়িত গতিপথ বন্যার অন্যতম কারণ। সর্পিল গতিপথ যুক্ত নদীতে পানির স্বাভাবিক অপসারণ বাধাপ্রাপ্ত হয়। ফলে নদী প্রণালীতে পানি দাঁড়িয়ে থাকে। এই অবস্থায় দীর্ঘস্থায়ী অতিবর্ষণে নদী প্রণালীতে পানি ক্রমপুঞ্জিভূত হয় এবং একটি সময়ে অতিরিক্ত পানি নদীর পাড় ছাপিয়ে সর্পিল গতিপথের সন্নিকটস্থ অঞ্চলকে প্লাবিত করে।
গ) নদীর স্বাভাবিক প্রবাহে প্রতিবন্ধকতা: ভ‚মিকম্প বা অন্যান্য প্রাকৃতিক কারণে ধস্ নেমে নদীতে পানির স্বাভাবিক মুক্ত প্রবাহে বাধার সৃষ্টি হলে বন্যা প্ররোচিত হতে পারে। কারণ ধস্জনিত বাধা দূরীকরণের ফলে নদীর নি¤œ অববাহিকায় ফ্ল্যাশ-ফ্লাড সৃষ্টি হতে পারে।
ঘ) বিস্তৃত বন্যাপ্রবণ সমতলভ‚মি: নদীর গতিপথে বিস্তৃত বন্যাপ্রবণ সমতলভ‚মিতে বন্যার তীব্রতা এবং বিস্তারকে বৃদ্ধি করে।
ঙ) নদী প্রণালীর ঢাল বা নতির পরিবর্তন: পর্বতের পাদদেশীয় ঢাল এবং সমতলের উচ্চপ্রান্তের মধ্যবর্তী নদী প্রণালীর নতির হঠাৎ পরিবর্তন বন্যা প্ররোচিত করে।
চ) সাইক্লোন: যুগপৎ মুষলধারে বৃষ্টি এবং নি¤œচাপ বা ডিপ্রেসানজনিত জলোচ্ছ¡াসে উপক‚লবর্তী নিচু অঞ্চল প্লাবিত হতে পারে।
ছ) হিমালয়ের শীর্ষে তুষারের গলন: প্রবল বর্ষণ ব্যতিরেকে হিমালয়ের শীর্ষে সঞ্চিত বরফের বেশিমাত্রায় গলন বন্যার অন্যতম কারণ।
বন্যার মনুষ্যসৃষ্ট কারণ:
ক) নদী প্রণালীর পরিবর্তন: নদী প্রণালীর কৃত্রিম পরিবর্তন বন্যাকে প্ররোচিত করে। পানিবিদ্যুৎ উৎপাদন এবং পানিসেচের কারণে নদী প্রণালীতে বাঁধ এবং বিজার্ভার নির্মিত হলে নদীর নি¤œ অববাহিকায় বন্যা দেখা দিতে পারে। বর্ষাকালে অতিবর্ষণ এবং বাঁধ বা রিজার্ভার থেকে পানিনির্গমন যদি যুগপৎ ঘটে তাহলে নির্গত প্রবাহের আধিক্যের কারণে নদীর নি¤œ অববাহিকায় বন্যা সৃষ্টি হতে পারে। এছাড়া নদী প্রণালীতে বাঁধ দিয়ে এবং খাল কেটে নদীকে ভিন্নমুখী করলেও ভিন্নমুখ নদী সন্নিকটস্থ সমতলে বন্যা ঘটাতে পারে।
খ) নদীগর্ভে পলিসঞ্চয়: নদীগর্ভে পলিসঞ্চিত হলে বন্যা প্ররোচিত হয়। অতিবর্ষণে তীর পৃষ্ঠীয় প্রবাহের দ্বারা শীর্ষ-মৃত্তিকা ক্ষয়িত হয়ে নদীগর্ভে জমা হয়। নদীগর্ভে সঞ্চিত শীর্ষ মৃত্তিকাকে ‘পলি’ বলা হয়। এইভাবে নদীগর্ভে পলির ক্রমসঞ্চয়ে নদীর নাব্য হ্রাস পায়। ফলে, বর্ষাকালে অতিবর্ষণজনিত নদীপ্রণালী ধরে রাখতে সক্ষম হয় না। এমতাবস্থায় নদীক‚ল উপছিয়ে যাওয়া পানি নদীর উভয় পার্শ্বের সমতলকে প্লাবিত করে। এইভাবে নদীগর্ভে পলিসঞ্চয়জনিত কারণে নদীর নাব্য হ্রাস বন্যার তীব্রতা এবং বিস্তারকে বহুলাংশে বৃদ্ধি করে। মৃত্তিকা ক্ষয়ের মুনষ্যসৃষ্ট কারণগুলি উল্লেখ করা হলো:
যথাযথ নয় এমন কৃষিরীতি, যথা: ১. উৎপাদন বৃদ্ধিকারক শস্যের চাষ (অর্থাৎ পর্যায়ক্রমিক শস্য বপন না করা। ২. ন্যূনতম অঞ্চল ভ‚মিকর্ষণ এবং ঢালচিহ্ন বরাবর হলকর্ষণরীতি অনুসরণ না করা। ৩. মৃত্তিকা ক্ষয়প্রবণ প্রান্তীয় ভ‚মিতে (যথা পাহাড়ের খাড়া ঢালে) চাষাবাদ এবং মৃত্তিকা ক্ষয়প্রবণ জমিতে গবাদিপশু প্রতিপালন। ৪. শিল্পাপয়ন, নগরায়ণ এবং ৫. কৃষ্টিতে জমি সরবরাহ করার জন্য অরণ্যনিধন। তৃণভ‚মির ভুল পরিচালন।
যথাযথ নয় এমন শিল্পায়ন এবং নগরায়ণ।
(রাস্তাঘাটা, পাকাবাড়ী, কংক্রিট ফুটপাথ এবং সিমেন্ট বাঁধানো অঙ্গন বা বাড়ীর উঠান ইত্যাদি বৃষ্টিজনিত সঞ্চিত পৃষ্ঠীয় পানিকে মৃত্তিকায় অনুপ্রবেশে বা চুইয়ে যাওয়াতে বাধা দান করে। এই কারণে পৃষ্ঠীয় প্রবাহ তীব্রতর হয়। এই তীব্র পৃষ্ঠীয় প্রবাহ যখন অনাবৃত মৃত্তিকার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয় তখন শীর্ষ-মৃত্তিকা ক্ষয়ে যায়।)
নদীপার্শ্বস্থ প্রাকৃতিক ভৌত পরিবেশের বিনাশ: অধিকাংশ উন্নয়নশীল দেশে, বিশেষত বাংলাদেশে, জনসংখ্যার চাপে নদী পার্শ্বস্থ প্রাকৃতিক ভৌত পরিবেশ ক্রমশঃ ধ্বংস হচ্ছে। নদীর বাঁধ, বন্যা প্রাচীর এবং বন্যাপ্রবণ নিচু অঞ্চলে অবৈধভাবে জনবসতি গড়ে ওঠায় নদী প্রণালী ক্রমসঙ্কুচিত হচ্ছে। এছাড়া পৌরসংস্থার জঞ্জাল এবং নর্দমা নির্গত আবর্জনার প্রভাবে নদীগর্ভ ক্রমশ ভরাট হচ্ছে, ফলে নদী প্রণালীর নাব্য হ্রাস পাচ্ছে। এইসব কারণে নদীপার্শ্বস্থ প্রাকৃতিক ভৌত পরিবেশ ধ্বংস হওয়ায় বর্ষাকালে নদীতে বন্যা প্ররোচিত হচ্ছে।
বন্যার সর্বনাশা প্রভাব:
বন্যার ফলে মানুষ এবং মানব সম্পদের অপরিমেয় ক্ষতি হয়। ক্ষতির প্রকৃতি অতিসংক্ষেপে উল্লেখ করা হলো:
ক) বন্যার করাল গ্রাসে অসংখ্য মানুষের মৃত্যু হয় (যথা: পানিতে ডুবে, রোগের আক্রমণে, খাদ্যের অভাবে, সাপের কামড়ে, বাড়ী-ঘর ধসে গিয়ে এবং বাজ পড়ে)।
খ) মাটির তৈরি বাড়ী ধ্বংস হয়, ভ‚তল যোগাযোগ বিনষ্ট হয় এবং পানি ও বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়।
গ) কৃষিজাত শস্য বিনষ্ট হয়।
ঘ) অসংখ্য বন্য এবং গৃহপালিত প্রাণী ও উদ্ভিদ মারা যায়।
ঙ) বহুলাংশে স্থলজ বাস্তুতন্ত্র বিনষ্ট হয় এবং জলজ বাস্তুতন্ত্রের অনভিপ্রেত পরিবর্তন ঘটে।
চ) উর্বর জমিতে বন্যাজনিত বালি সঞ্চয়ে জমির উৎপাদনশীলতা হ্রাস পায় (যদিও সঞ্চিত পলি অনেক ক্ষেত্রে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করে)।
এছাড়া বন্যাক্লিষ্ট মানুষের চিকিৎসা, খাদ্য ও বস্ত্র সরবরাহ, বাড়ী তৈরির অনুদান, রাস্তাঘাট পুননির্মাণ, বিদ্যুৎ ও জলসরবরাহের ব্যবস্থায় পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং অন্যান্য যোগাযোগ ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা প্রভৃতির কারণে আর্থিক ক্ষতি হয়।
বন্যা নিয়ন্ত্রণ:
বন্যা প্রাকৃতিক দুর্ঘটনা হলেও কয়েকটি উপায়ে এর তীব্রতা এবং বিস্তার নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে। বন্যা নিয়ন্ত্রণের কয়েকটি উপায় সংক্ষেপে আলোচনা করা হল:
ক) বাঁধ থেকে পানি নির্গত করার পূর্বে পূর্বাভাস এবং বিপদ সঙ্কেত দেওয়া উচিত। এর ফলে মানুষ যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করার সময় পেতে পারে। এছাড়া সাইক্লোন সৃষ্ট অতিবৃষ্টির সম্ভাবনা সম্পর্কে পূর্বাভাস দেওয়ার জন্য আধুনিক পূর্বাভাস ও বিপদ সঙ্কেত জ্ঞাপক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। এতে যুগপৎ সংঘটিত বৃষ্টি এবং বাঁধ থেকে পানি নির্গমনজনিত বিপদ এড়ানো যায়।
খ) নদীর প্রবাহিত পানিকে মূল প্রণালীতে সীমাবদ্ধ রাখার জন্য নদীর উভয় পার্শ্বে মাটি, পাথর বা কংক্রিট দিয়ে বাঁধ নির্মাণ করা বা বন্যা-প্রাচীর গড়ে তোলা উচিৎ।
বৃষ্টির সময় পৃষ্ঠীয়-প্রবাহের তীব্রতা হ্রাস করার জন্য অনাবৃত পাহাড়িয়া অঞ্চলে বনসৃজন, পুনঃবনসৃজনের মাধ্যমে উদ্ভিদ আচ্ছাদন সৃষ্টি করা উচিত।
উদ্ভিদ আচ্ছাদন মৃত্তিকায় পানির অনুপ্রবেশ বৃদ্ধি করে, ফলে পৃষ্ঠীয় প্রবাহের তীব্রতা হ্রাস পায় (এবং পরোক্ষভাবে বন্যার আশঙ্কা হ্রাস পায়) এছাড়া আচ্ছাদন সৃজনের মাধ্যমে মৃত্তিকার ক্ষয়রোধ করা যায়।
সর্পিল গতিপথযুক্ত নদীতে বন্যা হ্রাস বা রোধ করার জন্য গতিপথের সর্পিল ফাঁস অংশকে কৃত্রিম উপায়ে (মাটি কেটে) অবক্র বা ঋজু করা প্রয়োজন। পানি এই ঋজু প্রণালীর মাধ্যমে সর্পিল প্রণালীর তুলনায় অপেক্ষাকৃত বেশি গতিবেগ নিষ্কাশিত হতে পারে। ফলে সর্পিল বন্যা-সমতলে বন্যার তীব্রতা ও বিস্তার অনেকটা কমে যায়। যদিও তৃতীয় বিশ্বে এবং উন্নয়নশীল দেশে এই পদ্ধতিতে প্রয়োগ করা সম্ভব নয়, কারণ এই উপায়ে বন্যা হ্রাসে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন।
বন্যার তীব্রতা ও বিস্তার হ্রাস করার জন্য নদীর গতিপথে অসংখ্য বন্যা নিয়ন্ত্রক রিজার্ভার তৈরি করা উচিত। এতে নদী প্রণালীর মাধ্যমে পানির নিষ্কাশন হ্রাস করা যায়। এছাড়া রিজার্ভারে সঞ্চিত পানি সেচের কাজে এবং জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের কাজে লাগানো।
নদী প্রণালীতে পানিধারণ ক্ষমতা বা নাব্যতা বৃদ্ধি করে বন্যার তীব্রতা ও বিস্তার হ্রাস করা যায়। নাব্যতা বৃদ্ধি দু’ভাবে করা যায়: নদীগর্ভ থেকে সঞ্চিত পলি অপসারণ করে (এই পদ্ধতি অত্যধিক ব্যয়বহুল) বা পলিসঞ্চয় রোধ করা যেতে পারে। মৃত্তিকার ক্ষয় হার হ্রাস করে। নি¤œবর্ণিত উপায়ে মৃত্তিকা-ক্ষয় হ্রাস করা যেতে পারে:
পর্যায়ক্রমিক শস্য বপন, প্রান্তীয় জমিতে চাষাবাদ নিয়ন্ত্রণ, ঢালচিহ্ন বরাবর হলকর্ষণ, ন্যূনতম অঞ্চলে ভ‚মিকর্ষণ, পশুপালন নিয়ন্ত্রণ, আংশিক বা অনুর্বর জমিতে বনসৃজন বা পুনঃবনসৃজন, তৃণভ‚মি এবং আচ্ছাদিত জমির যথাযথ পরিচালন, পরিকল্পিত নগরায়ণ এবং শিল্পায়ন।
নদীপ্রণালীতে বর্দ্ধিত নির্গত পানিপ্রবাহকে উঁচু বাঁধ দিয়ে ঘেরা নিচু সমতলে (যেখানে কৃষিজমি এবং জনবসতি নেই) বা কৃত্রিম উপায়ে খনন করা খালে ভিন্নমুখী করে বন্যার তীব্রতাকে হ্রাস করা যায়।