হোমরুল আন্দোলনের উত্‍পত্তি, বিকাশ ও ফলাফল।

 

সূচনাঃ- ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা হয়। কিন্তু ইহার সদস্যদের মধ্যে অধিকাংশ সক্রিয়ভাবে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের পক্ষপাতী ছিলেন না। অন্যদিকে বালগঙ্গাধর তিলক, অরবিন্দ ঘোষ, লালা লাজপত রায়, বিপিনচন্দ্র পাল প্রমুখ ব্যক্তিগণ ছিলেন সক্রিয় আন্দোলনের পক্ষপাতী। এইভাবে কংগ্রেস নরমপন্থী ও চরমপন্থী এই দুই দলে বিভক্ত হয়ে যায়। ১৯০৭ খ্রীস্টাব্দে এই দুই দলের মধ্যে প্রাকাশ্যে বিরোধ শুরু হয়ে যায়। ১৯০৭ খ্রীস্টাব্দে ব্রিটিশ সরকারকে তিলককে কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেন। ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে মুক্তি লাভের পর তিনি ভারতে সায়ত্ত শাসন স্থাপনের জন্য একটি রাজনৈতিক সঙ্ঘ স্থাপনে উদ্যোগী হন।

তিলকের হোমরুল আন্দোলনঃ- কংগ্রেসের সকল সদস্যরা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সক্রিয় আন্দোলনে অংশগ্রহণে ইচ্ছুক না হওয়ায় তীলক চরমপন্থীদের নিয়ে 'হোমরুল লীগ' গঠন করেন। হোমরুল লীগ এর এই আন্দোলন হোমরুল আন্দোলন নামে খ্যাত। এদের প্রধান দাবি ছিল স্বায়ত্তশাসনের অধিকার অর্জন করা।

কিছু কিছু কংগ্রেস নেতা মনে করতেন যে যুদ্ধের সময় ইংরেজ সরকারের কাছে স্বায়ত্তশাসন দাবি করে সরকারের উপর চাপ দেওয়া উচিত উচিত নয়। কিন্তু তিলক বলেন যে, 'যদি যুদ্ধের সময় ইংল্যান্ডের হাত থেকে আয়ারল্যান্ডের স্বায়ত্বশাসনের দাবী উত্থাপন করা যায় তবে ভারতের ক্ষেত্রে এই দাবী না করার কোনো কারণ নেই'। এই সময় অ্যানি বেশান্ত মাদ্রাজে অডিয়ারে ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে হোমরুল লীগের প্রতিষ্ঠা করেন। এ বছরই মহারাষ্ট্রে তিলক হোমরুল লীগের আরেকটি শাখা প্রতিষ্ঠা করেন। ক্রমশ মাদ্রাজ, বারানসি, কানপুর প্রভৃতি শহরেও হোমরুল লীগ এর শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়।

বেসান্তের হোমরুল আন্দোলনঃ- ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে মিসেস অ্যানি বেসান্ত হোমরুল লীগ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি মাদ্রাজের 'নিউ ইন্ডিয়া' ও 'কমন উইল' পত্রিকার মাধ্যমে এই মতবাদ প্রচার করেন যে ভারতবর্ষ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভেতর থাকলেও ভারতবাসীকে স্বায়ত্তশাসনের অধিকার দিতে হবে। তিলকের দাবির সঙ্গে তাঁর দাবি ছিল মোটামুটি এক। তবে তিলকের প্রতিষ্ঠানের তুলনায় তাঁর প্রতিষ্ঠান সর্বভারতীয় চরিত্র লাভ করে। তাঁর প্রতিষ্ঠিত োমরুল লীগের প্রায় ২০০টি শাখা ছিল। যাই হোক এই আন্দোলনের গভীরতা ও ব্যপকতা এতটাই ছিল যে ভারত সরকারের গোপন রিপোর্টে বলা হয়, "দেশের সকল লোক তিলক ও বেসান্তের পক্ষে চলে গেছে"।

হোমরুল আন্দোলনঃ- তিলকের নেতৃত্বে হোমরুল লীগের সদস্যরা স্বায়ত্তশাসন ও স্বরাজের অধিকার দাবী করেন। তিলক এই সময় ঘোষণা করেন "স্বরাজ আমার জন্মগত অধিকার"। হাজার হাজার ইস্তাহার দ্বারা জনসাধারণের মধ্যে স্বায়ত্ব শাসনের দাবী প্রচার করা হয়। এছাড়া বহু সভা-সমিতির মাধ্যমে এই দাবী উত্থাপন করা হয়। এই সময় লোকমান্য তিলক তার বিখ্যাত বক্তৃতাবলী প্রদান করেন। এই বক্তৃতায় তিনি ভূমি রাজস্ব সম্পর্কে প্রতিবাদ জানান।

দমন নীতিঃ- হোমরুল আন্দোলনের ব্যাপকতা ইংরেজ সরকার কিছুটা সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন। সরকারের ধারণা হল যে দেশের জনসাধারণ ইংরেজদের বিপক্ষে চলে গেছে। ফলে সরকারের রোষবহ্নী তিলক ও বেসান্তের উপর গিয়ে পড়ে। সরকার দমন নীতির মাধ্যমে এই আন্দোলন রোধ করার চেষ্টা করেন, কিন্তু ইহারর ফল হলো বিপরীত।দমন নীতির ফলে আন্দোলন বন্ধ হওয়া দূরে থাক ইহা আরো দ্রুত প্রসার লাভ করল। ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে বেসান্ত ও তাঁর সহকর্মীগন গ্রেফতার হন। তিলককে গ্রেফতার করে কুড়ি হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। কিন্তু তিনি টাকা দিতে অস্বীকার করেন।

ফলাফলঃ- তিলক ও বেসান্তের গ্রেফতারে সারাদেশ উত্তাল হয়ে ওঠে। জাতীয় কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ হোমরুল আন্দোলনকে সমর্থনই করল। শুধু তাই নয় তিলক ও বেসান্তের গ্রেফতারের প্রতিবাদে জাতীয় কংগ্রেস আন্দোলনে নামার হুমকি দেয়। এমনকি মহম্মদ আলি জিন্নাহ ও মুসলিম লীগ সরকারকে ধিক্কার জানান। অবস্থা আয়ত্তের বাইরে চলে যাচ্ছে দেখে ব্রিটিশ সরকার ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে মন্টেগু-চেমসফোর্ড শাসন সংস্কার প্রবর্তন করেন।

উপসংহারঃ- হোমরুল আন্দোলন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে এক উল্লেখযোগ্য অধ্যায়। এই আন্দোলনের ফলে এক নতুন প্রজন্মের উদ্ভব হয় যারা পরে জাতীয় আন্দোলনের মুখ্য স্থান অধিকার করেন। বেসান্তের আন্দোলনের ফলে মাদ্রাজের তামিল ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়, উত্তরপ্রদেশের কায়স্থ, কাশ্মীরি ব্রাহ্মণ, বোম্বাই এবং গুজরাটী শিল্পীপতি গোষ্ঠী ও আইনজীবীরা জাতীয় আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। মহারাষ্ট্রে কেবলমাত্র উচ্চবর্ণের চিতপাবন ব্রাহ্মণরাই হোমরুল আন্দোলন যোগদান করেন এ কথা ঠিক নয়। বণিক, গুর্জার, মারাঠী প্রভৃতি বিভিন্ন সম্প্রদায়ের লোক এই আন্দোলনে শামিল হন। হোমরুল আন্দোলনের মধ্য দিয়ে মাদ্রাজে সত্যমূর্তি বাংলায়, বাংলায় জে.এল.ব্যানার্জি, এলাহাবাদে জহরলাল নেহেরু প্রভৃতি বিখ্যাত উদীয়মান নেতার উদ্ভব হয়।

Catagories