বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগ মধ্যযুগের,
ইতিহাসে এক অন্যতম সময়কাল। বাংলা সাহিত্যে চর্যাপদের যেমন একটা ঐতিহাসিক
গুরুত্ব রয়েছে তেমনি মধ্যযুগের প্রথম গ্রন্থ শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের
গুরুত্ব রয়েছে। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য আবিষ্কারের আগে মধ্যযুগের পদাবলী
সাহিত্য সহ অন্যান্য সাহিত্য প্রচলিত ছিল এবং তাদের জনপ্রিয়তা ছিল।
পদাবলীর চন্ডীদাস বাংলার জীবনের সবচেয়ে পরিচিত ছিল কিন্তু ১৯১৬ সালে
শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য প্রকাশিত হলে মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের তৈরি হয় এক
জটিলতা।এই জটিলতাই হলো চন্ডীদাস সমস্যা।
বস্তুত চন্ডীদাস নামক কবির সংখ্যা সংখ্যাও তাদের পরিচয় নিয়ে
বিতর্কে সূচনা হয়েছে চৈতন্যদেবের আস্বাদিত কবি চন্ডীদাস এর ঐতিহাসিক মূল
সন্ধান করতে গিয়ে। বড়ু চন্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন আবিষ্কার আগে থেকে
চণ্ডীদাসের ভনিতাযুক্ত৷ অনেক পদ পাওয়া যাচ্ছিল। তখন সাধারণ বাঙালিমানসে
চন্ডীদাস ছিলেন এক জন তারা কখনো ভাবতে পারেনি একজনের বেশি চণ্ডীদাস থাকতে
পারে। শ্রী ভূদেব চৌধুরী বলেন :-
শ্রীভূদেব চৌধুরী পৃ. ১৩৭]
১৩০৫ বাংলা সালের নীলরতন মুখোপাধ্যায় চন্ডীদাসের নামাঙ্কিত রসলীলা বিষয়ক কিছু সংখ্যক অভিনব পদ আবিষ্কার করেন। পরে ১৩২১ সালে ব্যোমকেশ মুস্তাফী কৃষ্ণের জন্মলীলা বিষয়ক কিছু কিছু পদ প্রকাশ করেছিলেন। সকল পদেই চন্ডীদাসের ভনিতা থাকলেও রচনাগত দিক থেকে এগুলোকে পদাবলীর চণ্ডীদাসের বলে স্বীকার করতে কেউ পারে। শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন আবিষ্কারের পর রীতিমত প্রশ্ন উঠতে থাকে যে বাংলা সাহিত্যে চন্ডীদাস কয়জন এবং কোন চন্ডীদাস কোনটি রচনা করেছেন।
বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য প্রকাশিত হয়। কবির নাম বড়ু চন্ডীদাস কাব্যটি প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই এই কাব্যের প্রাচীনতা ও বড়ু চন্ডীদাসে যথার্থ পরিচয় নিয়ে প্রচন্ড কলরব ওঠে। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের কবি বড়ু চন্ডীদাস। কিন্তু সমস্যা হল এই কাব্যের ৪০৩টি ভণিতার মধ্যে ২৮৯ টিতে বড়ু চন্ডীদাস, ১০৭ টিতে শুধু চন্ডীদাস, এবং ৭ টিতে অনন্ত বা অনন্ত বড়ু চন্ডীদাস নাম রয়ে। এছাড়া নামহীন ভণিতার সংখ্যা পাঁচটি।
মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যে আমরা চন্ডীদাস নামের অন্ততপক্ষে পাঁচজন কবির নাম পাই। তাঁরা হলেন বড়ু চন্ডীদাস, চন্ডিদাস, দীন চন্ডীদাস,দ্বিজ চন্ডিদাস এবং একই নামের শেষ কবি দ্বিজ চন্ডীদাস।
প্রথম চন্ডীদাস হলেন বড়ু চন্ডীদা।। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের কবি তাঁর নাম অনন্ত। তাঁর কৌলিক উপাধি বড়ু। আর তাঁর দীক্ষাগুরুর নাম চন্ডীদাস। কবি শাক্তদেবী বাশুলীর সেবক ছিলেন তিনি তা ভিনিতায় স্বীকার করেছেন ডঃ অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় মনে করেন:-
" কবির নাম বড়ু চন্ডীদাস, ভণিতায় কবি এইভাবে
নিজের নাম উল্লেখ করেছেন। কাব্যের ভিতরে বহুবার
কবি নিজেকে এই নামে অভিহিত করেছেন। সুতরাং
তাঁর নাম বড়ু চন্ডীদাস তাতে কোন সন্দেহ নেই।"
[বাংলা সাহিত্যের সম্পূর্ণ ইতিবৃত্ত
অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় পৃ.২৬]
দ্বিতীয় চন্ডীদাস হলেন চৈতন্য পূর্ববর্তী কালের বৈষ্ণব পদ রচয়িতা জনপ্রিয় কবি। স্বয়ং চৈতন্যদেব পর্যন্ত তাঁর পদের রস মাধুর্য্য আস্বাদন করতেন। তাঁর প্রত্যেকটি ভণিতায় বিশেষনহীন চন্ডীদাস আছে। প্রত্যেকটি ভণিতার বিশেষত্ব এই যে, কহে, কয় বা বলে ক্রিয়ার সহিত পদের শেষ কলির প্রথমে চন্ডীদাসের নাম আছে এবং কবির ব্যক্তিগত মন্তব্য আছে। তাই শ্রীভূদেব চৌধুরী বলেন :-
" চন্ডীদাস শুধুই চন্ডীদাস- তিনি বড়ু চন্ডীদাস নহেন,
দ্বীজ চন্ডীদাস নহেন, দীন চন্ডীদাস নহেন, কোন
সহজিয়া পদের রচয়িতা আদি চন্ডীদাস রসিক
চন্ডীদাসও নহেন। "
[ বাংলা সাহিত্যের ইতিকথা
শ্রীভূদেব চৌধুরী পৃ১৪২]
তৃতীয় চন্ডীদাস হলেন দীন চণ্ডীদাস ইনি কৃষ্ণলীলার আখ্যানকাব্য তথা পালা গানের রচয়িতা। তিনি খুব একটা বিখ্যাত বা উচ্চাঙ্গের কবি নন। তাঁর পুস্তক প্রকাশিত হলে দেখা গেল পুঁথিটি আদি অন্ত সুপরিকল্পিত পালার আকারে লেখা। আগাগোড়া কাব্যে চন্ডীদাসের ভনিতা রয়েছে বেশিরভাগ স্থলে কেবল চন্ডীদাস। তাছাড়া দীনচন্ডীদাস, দীনক্ষীণ চন্ডিদাস, এবং দ্বিজ চন্ডীদাস নামগুলি ও ব্যবহৃত হয়েছে।এই কাব্যের বিষয়ে চৈতন্য পরবর্তী ধর্ম ও রস-শাস্ত্রগত পরিকল্পনার প্রভাব-লক্ষণ সুস্পষ্ট।
"একজনের বেশি বৈষ্ণব পদকর্তার যে চন্ডীদাস না থাকা সম্ভব, এই
কল্পনাও একালে ছিল স্বপ্নাতীত। এ সম্বন্ধে সংশয় অবশ্য শ্রীকৃষ্ণকীর্তন
আবিষ্কারের আগে থেকেই অঙ্কুরিত হতে আরম্ভ করেছিল । "
[ বাংলা সাহিত্যের ইতিকথাশ্রীভূদেব চৌধুরী পৃ. ১৩৭]
১৩০৫ বাংলা সালের নীলরতন মুখোপাধ্যায় চন্ডীদাসের নামাঙ্কিত রসলীলা বিষয়ক কিছু সংখ্যক অভিনব পদ আবিষ্কার করেন। পরে ১৩২১ সালে ব্যোমকেশ মুস্তাফী কৃষ্ণের জন্মলীলা বিষয়ক কিছু কিছু পদ প্রকাশ করেছিলেন। সকল পদেই চন্ডীদাসের ভনিতা থাকলেও রচনাগত দিক থেকে এগুলোকে পদাবলীর চণ্ডীদাসের বলে স্বীকার করতে কেউ পারে। শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন আবিষ্কারের পর রীতিমত প্রশ্ন উঠতে থাকে যে বাংলা সাহিত্যে চন্ডীদাস কয়জন এবং কোন চন্ডীদাস কোনটি রচনা করেছেন।
বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য প্রকাশিত হয়। কবির নাম বড়ু চন্ডীদাস কাব্যটি প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই এই কাব্যের প্রাচীনতা ও বড়ু চন্ডীদাসে যথার্থ পরিচয় নিয়ে প্রচন্ড কলরব ওঠে। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের কবি বড়ু চন্ডীদাস। কিন্তু সমস্যা হল এই কাব্যের ৪০৩টি ভণিতার মধ্যে ২৮৯ টিতে বড়ু চন্ডীদাস, ১০৭ টিতে শুধু চন্ডীদাস, এবং ৭ টিতে অনন্ত বা অনন্ত বড়ু চন্ডীদাস নাম রয়ে। এছাড়া নামহীন ভণিতার সংখ্যা পাঁচটি।
মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যে আমরা চন্ডীদাস নামের অন্ততপক্ষে পাঁচজন কবির নাম পাই। তাঁরা হলেন বড়ু চন্ডীদাস, চন্ডিদাস, দীন চন্ডীদাস,দ্বিজ চন্ডিদাস এবং একই নামের শেষ কবি দ্বিজ চন্ডীদাস।
প্রথম চন্ডীদাস হলেন বড়ু চন্ডীদা।। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের কবি তাঁর নাম অনন্ত। তাঁর কৌলিক উপাধি বড়ু। আর তাঁর দীক্ষাগুরুর নাম চন্ডীদাস। কবি শাক্তদেবী বাশুলীর সেবক ছিলেন তিনি তা ভিনিতায় স্বীকার করেছেন ডঃ অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় মনে করেন:-
" কবির নাম বড়ু চন্ডীদাস, ভণিতায় কবি এইভাবে
নিজের নাম উল্লেখ করেছেন। কাব্যের ভিতরে বহুবার
কবি নিজেকে এই নামে অভিহিত করেছেন। সুতরাং
তাঁর নাম বড়ু চন্ডীদাস তাতে কোন সন্দেহ নেই।"
[বাংলা সাহিত্যের সম্পূর্ণ ইতিবৃত্ত
অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় পৃ.২৬]
দ্বিতীয় চন্ডীদাস হলেন চৈতন্য পূর্ববর্তী কালের বৈষ্ণব পদ রচয়িতা জনপ্রিয় কবি। স্বয়ং চৈতন্যদেব পর্যন্ত তাঁর পদের রস মাধুর্য্য আস্বাদন করতেন। তাঁর প্রত্যেকটি ভণিতায় বিশেষনহীন চন্ডীদাস আছে। প্রত্যেকটি ভণিতার বিশেষত্ব এই যে, কহে, কয় বা বলে ক্রিয়ার সহিত পদের শেষ কলির প্রথমে চন্ডীদাসের নাম আছে এবং কবির ব্যক্তিগত মন্তব্য আছে। তাই শ্রীভূদেব চৌধুরী বলেন :-
" চন্ডীদাস শুধুই চন্ডীদাস- তিনি বড়ু চন্ডীদাস নহেন,
দ্বীজ চন্ডীদাস নহেন, দীন চন্ডীদাস নহেন, কোন
সহজিয়া পদের রচয়িতা আদি চন্ডীদাস রসিক
চন্ডীদাসও নহেন। "
[ বাংলা সাহিত্যের ইতিকথা
শ্রীভূদেব চৌধুরী পৃ১৪২]
তৃতীয় চন্ডীদাস হলেন দীন চণ্ডীদাস ইনি কৃষ্ণলীলার আখ্যানকাব্য তথা পালা গানের রচয়িতা। তিনি খুব একটা বিখ্যাত বা উচ্চাঙ্গের কবি নন। তাঁর পুস্তক প্রকাশিত হলে দেখা গেল পুঁথিটি আদি অন্ত সুপরিকল্পিত পালার আকারে লেখা। আগাগোড়া কাব্যে চন্ডীদাসের ভনিতা রয়েছে বেশিরভাগ স্থলে কেবল চন্ডীদাস। তাছাড়া দীনচন্ডীদাস, দীনক্ষীণ চন্ডিদাস, এবং দ্বিজ চন্ডীদাস নামগুলি ও ব্যবহৃত হয়েছে।এই কাব্যের বিষয়ে চৈতন্য পরবর্তী ধর্ম ও রস-শাস্ত্রগত পরিকল্পনার প্রভাব-লক্ষণ সুস্পষ্ট।
চতুর্থ চণ্ডীদাস হলেন সহজিয়া সাধকদের মনগড়া কবি দ্বিজ চন্ডীদাস। প্রকৃতপক্ষে এই কবির কোন বাস্তব অস্তিত্ব ছিল না। ডঃ আহমদ শরীফ বলেন:-
" এই দ্বিজ চন্ডীদাস বলে আদৌ কোন কবি ছিলেন
কিনা বলা যায় না বলা যায় ।"
[বাঙালি ও বাঙলা সাহিত্য, ডঃ আহমদ শরীফ পৃ. ২৭৮]
অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতকে লিপিকৃত দুইটি পুঁথিতে দ্বিজ চন্ডিদাসের কিছু পরিচয় পাওয়া গেলেও নির্ভরযোগ্য কোন প্রমাণ মেলে না। তাই এই কবির অস্তিত্ব অস্বীকা।
পঞ্চম চন্ডীদাস, এই কবির নামও দ্বিজ চন্ডীদাস। অর্থাৎ এক নামে দুই জন কবির পরিচয় পাওয়া যা। তবে পূর্ববর্তী কবি চন্ডীদাসের অস্তিত্ব অস্বীকার্য হলেও এর অস্তিত্ব স্বীকার্য। আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ চট্টগ্রাম থেকে "কলঙ্কভঞ্জন" নামে দ্বিজ চন্ডীদাসের একটি পুঁথি আবিষ্কার করেন। এই পুঁথির লিপিকা ১৮২০ খ্রিষ্টাব্দের। ইনি চট্টগ্রাম বাসীর সাধারণ কবি।
চন্ডীদাস সমস্যা সমাধানের জন্য আমরা এই পাঁচজনের মধ্যে দিয়ে দ্বিজ চন্ডীদাস নাম বাদ দিলে আমরা তিন জন চন্ডীদাস পাই। তাঁরা হলেন বড়ু চন্ডীদাস, চন্ডীদাস, দীন চন্ডীদাস। এরা প্রত্যেকেই রাঢ় অঞ্চলের লোক। খগেন্দ্রনাথ মিত্র তাঁর, "বাংলা সাহিত্যের আলোচনা" গ্রন্থে এ কথা প্রমাণ করেছে। এক অঞ্চলের লোক হওয়া শুরু হয়েছে নানা বিভ্রাট। তাছাড়া পদাবলীর চন্ডীদাস আর শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের চন্ডিদাস এর মধ্যে সময়ের পার্থক্য ততটা প্রকট নয়। এই সমস্যা সমাধানের জন্য শ্রীকৃষ্ণকীর্তন ও বৈষ্ণব পদাবলী এই দুয়ের ভাব, ভাষা, চরিত্র বিচার করে দেখা যেতে পারে।বড়ু চন্ডীদাসের ভনিতায় কোন স্থানে দ্বিজ চন্ডীদাস উল্লেখ নেই। পদালীতে চন্দ্রাবলী রাধার নামান্তর। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের রাধা গোয়ালিনী মাত্র কাব্যের রাজকন্যা নয়।