মঙ্গলকাব্য নিয়ে বিস্তারিত তথ্য

মঙ্গলকাব্য


মধ্যযুগের কাব্যের প্রধান একটি ধারা হলো মঙ্গলকাব্য। মঙ্গল শব্দের আভিধানিক অর্থ কল্যাণ। যে কাব্য পাঠ করলে কল্যাণ হয়। এবং সকল প্রকার অকল্যাণ দূর হয় সে কাবাই মঙ্গল কাব্য। মঙ্গলকাব্যের বিষয়বস্তু মূলত ধর্মবিষয়ক আখ্যান নির্ভর। বিভিন্ন


দেবদেবীর গুণগান এবং পূজা প্রতিষ্ঠার কাহিনি মঙ্গল কাব্যের উপজীব্য বিষয়। এ মঙ্গলকাব্যকে দুটি শ্রেণীতে ভাগ করা হয়। যথা- লৌকিক শ্রেণি ও পৌরাণিক শ্রেণি।


... মঙ্গল কাব্যের প্রধান শাখা ৩টি



১. মনসামঙ্গল কাব্য


২. চণ্ডীমঙ্গল কাব্য


৩. অন্নদামঙ্গল কাব্য


→ মঙ্গল কাব্যের অপ্রধান ধারা দুটি । ১. ধর্মমঙ্গল কাব্য ২. শিবমঙ্গল কাব্য / কালিকা মঙ্গল কাব্য


একটি সম্পূর্ণ মঙ্গলকাব্যে সাধারণত ৪টি অংশ থাকে। যথা: বন্দনা, আত্মপরিচয়, দেবখণ্ড, নরখন্ড ও আখ্যায়িকা (সূত্র: বাংলাপিডিয়া) → ড. দীনেশচন্দ্র সেনের মতে, মঙ্গলকাব্যে ৬২ জন কবির নাম পাওয়া যায়। ।


=>


• গুরুত্বপূর্ণ তথ্য


মঙ্গলকাব্যের প্রাচীনতম ধারা/কাব্য মনসামঙ্গল:


শ্রেষ্ঠ কাব্য - চণ্ডীমঙ্গল:


সর্বশেষ কাব্য অন্নদামঙ্গল


মনসামঙ্গল: বাংলা সাহিত্যে মঙ্গলকাব্য ধারার প্রাচীনতম ধারা মনসামঙ্গল। দেবী মনসার পূজা প্রচার ও চাঁদ সওদাগরের বিদ্রোহ এ কাব্যের মূল উপজীব্য বিষয়। মধ্যযুগের সবচেয়ে প্রতিবাদী পুরুষ চরিত্র চাঁদ সওদাগর। সাপের অধিষ্ঠাত্রী দেবী মনসার অপর নাম কেতকা ও পদ্মাবতী। এজন্য মনসা মঙ্গল কাব্যকে পদ্মাপুরাণও বলা হয়। মনসামঙ্গলের আদিকবি - কানাহরিদত্ত। আর, প্রধান / শ্রেষ্ঠ কবি বিজয়গুপ্ত। তার কাব্যের নাম 'পদ্মাপুরাণ'। মনসামঙ্গলের একমাত্র পশ্চিমবঙ্গীয় কবি / জনপ্রিয় কবি ক্ষেমানন্দ। তার উপাধি কেতকাদাস। তার কাব্যের নাম 'কেতকাপুরাণ'। এছাড়াও বিপ্রদাস পিপিলাই এ কাব্য ধারার অন্যতম কবি যার রচিত কাব্যের নাম- মনসাবিজয়। বাংলা সাহিত্যের ১ম মহিলা কবি চন্দ্রাবতীর পিতা দ্বিজ বংশীদাস এ কাব্য ধারার কবি।


✉ চণ্ডীমঙ্গল: মঙ্গলকাব্যধারার শ্রেষ্ঠ কাব্য চণ্ডীমঙ্গল কাব্য। দেবী চণ্ডীর গুণকীর্তন ও পূজা-প্রসার এ কাব্যের মূল উপজীব্য বিষয়। চণ্ডীমঙ্গল কাব্যটি ২ খণ্ডে বিভক্ত। এই কাব্যের প্রথম খণ্ডে কালকেতু-ফুল্লরার কাহিনি এবং দ্বিতীয় খণ্ডে ধনপতি লহনা-মুল্পনার কাহিনি বর্ণিত আছে। মধ্যযুগের সবচেয়ে প্রতীবাদী নারী চরিত্র হল ফুল্লরা। এই কাব্যের অন্তর্ভুক্ত 'ভাঁড়ুদত্ত' চরিত্রটিকে বলা হয় বাংলা সাহিত্যের প্রথম ঠগ চরিত্র। চণ্ডীমঙ্গল কাব্যধারার কবি দ্বিজ মাধবকে বলা হয় 'স্বভাব কবি'। • চণ্ডীমঙ্গলের আদি কবি- মানিক দত্ত; প্রধান/ শ্রেষ্ঠ কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্তী (ষোল শতকের কবি)।


মুকুন্দরাম চক্রবর্তী জন্মগ্রহণ করেন বর্ধমান জেলার দামুন্যা গ্রামে। তার জীবনকাল আনুমানিক ১৫৪০-১৬০৪ খ্রিস্টাব্দ। তিনি ব্রাহ্মণ জমিদার বাঁকুড়া রায়ের আশ্রয়ে ছিলেন। তিনি বাঁকুড়া রায়ের পুত্র রঘুনাথের গৃহশিক্ষক ছিলেন। পিতার মৃত্যুর পর রঘুনাথ জমিদার হলে মুকুন্দরাম চক্রবর্তী তার সভাকবি নিযুক্ত হন। জমিদার রঘুনাথের নির্দেশে মুকুন্দরাম 'শ্রী শ্রী চণ্ডীমঙ্গল' কাব্য রচনা করেন। জমিদার রঘুনাথ রায় কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্তীকে উপাধি দেন 'কবিকঙ্কন'। কবি মুকুন্দরামের সবচেয়ে জনপ্রিয় কাহিনি কাব্য- 'কালকেতু উপাখ্যান'। মুকুন্দরাম চক্রবর্তীকে আখ্যায়িত করা হয় দুঃখ বর্ণনার কবি হিসেবে।


অন্নদামঙ্গল মঙ্গলকাব্য ধারার সর্বশেষ কাব্য হলো অন্নদামঙ্গল কাব্য। এই কাব্যের রচয়িতা হলেন ভারতচন্দ্র রায় গুণাকর। অন্নদামঙ্গল কাব্য ৩ খণ্ডে বিভক্ত এবং তিনটি স্বতন্ত্র কাহিনিতে পূর্ণতা লাভ করেছে। প্রথম খণ্ডে শিবায়ন-অন্নদামঙ্গল, দ্বিতীয় খণ্ডে


বিদ্যাসুন্দর-কালিকামঙ্গল, তৃতীয় খণ্ডে মানসিংহ-ভবানন্দ অন্নদামঙ্গল এর কাহিনি বর্ণিত হয়েছে। ভারতচন্দ্র রায় গুণাকর এর জন্ম ভুরসুট পরগনার পাণ্ডুয়া গ্রামে (বর্তমান হাওরা জেলার পেরো গ্রামে)। ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরকে


বলা হয় মধ্যযুগের (আঠারো শতকের) শ্রেষ্ঠ কবি/ মধ্যযুগের নাগরিক কবি/ মঙ্গলযুগের সর্বশেষ কবি। তিনি কৃষ্ণনগর রাজসভার কবি ছিলেন। 'অন্নদামঙ্গল' কাব্য রচনার জন্য নবদ্বীপ-কৃষ্ণনগরের রাজা মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র তাকে 'গুণাকর' উপাধিতে ভূষিত করেন। ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দে এই কবির মৃত্যুর মধ্য দিয়ে বাংলা সাহিত্যে মধ্যযুগের অবসান ঘটে।


• অন্নদামঙ্গল কাব্যের বিখ্যাত পক্তি/ ভারতচন্দ্র রায়ের বিখ্যাত উক্তি ১। আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে।


প্রার্থনাটি ঈশ্বরী পাটনীর (পাটনী শব্দের অর্থ- মাঝি)


২। নগর পুড়িলে দেবালয় কি এড়ায়।


৪। কড়িতে বাঘের দুধ মেলে।


৫। বড়র পিরীতি বালির বাঁধা ক্ষণে হাতে দড়ি, ক্ষণের চাঁদ।


৩। মন্ত্রের সাধন কিংবা শরীর পাতন।


৬। জন্মভূমি জননী স্বর্গের গরিয়সী ।


ধর্মমঙ্গল কাব্য: ধর্মমঙ্গল কাব্যে পুরুষ দেবতার পরিচয় পাওয়া যায়; পুরুষ দেবতার নাম ধর্মঠাকুর। হিন্দু সমাজের নিচু স্তে বিশেষ করে ডোম সমাজে ধর্ম ঠাকুরের পূজা প্রচলিত রয়েছে। ধর্ম ঠাকুরের মাহাত্ম্য প্রচারের জন্যই ধর্মমঙ্গল কাব্যের সূত্রপ হয়েছে। বস্তুত, ধর্মমঙ্গল কাব্য দুটি পালায় বিভক্ত- ১. রাজা হরিশ্চন্দ্রের কাহিনি; ২. রাজা লাউসেনের কাহিনি। ধর্মমঙ্গল কাব্যধারার আদিকবি- ময়ূরভী। তার কাব্যের নাম হাকন্দ পুরাণ।


• এ ধারার শ্রেষ্ঠ কবি- ঘনরাম চক্রবর্তী। তার কাব্যের নাম শ্রী ধর্মমঙ্গল। • ধর্মমঙ্গল কাব্যের অন্যান্য উল্লেখযোগ্য কবিরা হলেন- রূপরাম চক্রবর্তী, আদি রূপরাম, মাণিকরাম, শ্যাম পণ্ডিত প্রমুখ। কালিকামঙ্গল কাব্য: দেবী কালীর মাহাত্ম্য বর্ণনামূলক গ্রন্থ কালিকামঙ্গল কাব্য। কাব্যটি বিদ্যা-সুন্দর কাব্য নামেও পরিচিত। এ


কাব্যের আদি কবি কবিকঙ্ক; শ্রেষ্ঠ কবি রামপ্রসাদ সেন (উপাধি- কবিরঞ্জন); মুসলমান কবি সাবিরিদ খান (মঙ্গলকাব্যের


একমাত্র মুসলিম কবি)।


একনজরে মঙ্গলকাব্যের রচয়িতা ও চরিত্রসমূহ


কাব্য


মনসামঙ্গল


চণ্ডীমঙ্গল


কানাহরি দত্ত


মানিকদত্ত


অন্নদামঙ্গল


ধর্মমঙ্গল


ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর


ময়ূর ভট


কালিকামঙ্গল


কবিকঙ্ক


প্রধান / শ্রেষ্ঠ কবি


বিজয়গুপ্ত


মুকুন্দরাম চক্রবর্তী


ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর


ঘনরাম চক্রবর্তী


চরিত্রসমূহ


মনসা, চাঁদ সওদাগার, বেহুলা, লখিন্দর


ফুল্লরা, কালকেতু, ধনপতি, ভাঁড়ুদত্ত, মুরারী শীল


ঈশ্বরী পাটনী, হীরামালিনী


হরিশ্চন্দ্র, লাউসেন


রামপ্রসাদ সেন


বিদ্যা, সুন্দর


বিবিধ গুরুত্বপূর্ণ তথ্য


মনসামঙ্গলের জনপ্রিয়তার জন্য বিভিন্ন কবির রচিত কাব্য থেকে বিভিন্ন অংশ সংকলিত করে যে পদসংকলন। রচনা করা হয়েছিল তাই বাংলা সাহিত্যে বাইশ কবির মনসামঙ্গল বা বাইশা নামে পরিচিত।


বারোমাস্যা মঙ্গলকাব্য ধারার কেন্দ্রীয় নারী চরিত্রের (নায়িকার) বারো মাসের সুখ দুঃখের বর্ণনাকে বারোমাস্যা বলে।


অনুবাদ সাহিত্য


মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের একটি উল্লেখযোগ্য ধারা হলো অনুবাদ সাহিত্য। সংস্কৃত, হিন্দি, আরবি ও ফারসি সাহিত্য থেকে মধ্যযুগে বাংলা সাহিত্যে অনুবাদ হয়েছে। অনুবাদ সাহিত্যে হিন্দু লেখকদের অনূদিত সাহিত্যের নাম সাহিত্যের কথা এবং মুসলিম লেখকদের অনূদিত সাহিত্যের নাম রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যান। সংক্ষেপে অনুবাদ সাহিত্যের আলোচনা করা হলো-


সংস্কৃত থেকে অনূদিত সাহিত্যসমূহ


রামায়ণ


• ভারতীয় পৌরাণিক ধারার আদি গ্রন্থ/ মহাকাব্য হলো রামায়ণ। সংস্কৃত ভাষায় ৭ খণ্ডে রচিত এ গ্রন্থের শ্লোক সংখ্যা ২৪,০০০ । রামায়ণের আদি/ মূল রচনাকারী- বাল্মীকি। তার আসল নাম- দস্যু রত্নাকর।


• রামায়ণের প্রথম ও শ্রেষ্ঠ অনুবাদক কবি কৃত্তিবাস ওঝা (পনের শতকের কবি)। তিনিই প্রথম বাংলা ভাষায় রামায়ণ রচনা করেন। তার রচিত রামায়ণের অন্যনাম- কৃত্তিবাসী রামায়ণ বা শ্রীরাম পাঁচালি। কৃত্তিবাস ওঝা ছিলেন সুলতান গিয়াসউদ্দীন আযম শাহ্ এর সভাকবি। • রামায়ণের প্রথম মহিলা অনুবাদক চন্দ্রাবতী। তিনি বাংলা সাহিত্যের প্রথম মহিলা কবি হিসেবে স্বীকৃত।


মহাভারত


• ভারতীয় পৌরাণিক ধারার শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ মহাভারত। মহাভারতের মূল রচয়িতা মহর্ষি কৃষ্ণ বৈদ্বপায়ন ব্যাসদেব (বেদব্যাস)।


• মহাভারত সংস্কৃত ভাষায় ১৮ খণ্ডে রচিত একটি মহাকাব্য। এ গ্রন্থের শ্লোক সংখ্যা ৮৫০০০। • মহাভারত বাংলায় প্রথম অনুবাদ করেন কবীন্দ্র পরমেশ্বর (ষোলো শতকের কবি)।


• মহাভারতের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও শ্রেষ্ঠ অনুবাদক কাশীরাম দাস (সতেরো শতকের কবি)। • সুলতান হোসেন শাহের সেনাপতি পরাগল খাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় কবীন্দ্র পরমেশ্বর মহাভারত অনুবাদ করেন যা ‘পরাগলী মহাভারত' নামে পরিচিত। পরাগল খাঁর ছেলে ছুটি খানের পৃষ্ঠপোষকতায় শ্রীকরনন্দী ‘ছুটি খানি মহাভারত" রচনা করেন।

Catagories