জীবগোষ্ঠীর সার্থক বাসভূমি হল এই পৃথিবী। পৃথিবীর প্রায় সর্বত্রই ছোটো বড়ো উদ্ভিদ ও প্রানীর সমাবেশ লক্ষ করা যায়। পৃথিবীর যে কোনো স্থানে বিভিন্ন প্রকার জীবের এই বৈচিত্র্যপূর্ন সমাবেশ হল জীববৈচিত্র্য। জীববৈচিত্র্য বলতে সাধারণত একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে বিভিন্ন প্রকার জীবের একত্র সমাবেশ কে বোঝানো হয়ে থাকে। আবার অন্য ভাবে বললে কোনো অঞ্চলের নির্দিষ্ট প্রজাতির মধ্যে জীনগত, প্রজাতিগত ও বাস্তুতান্ত্রিক যে তারতম্য বা বিভিন্নতা রয়েছে, তাই হল জীববৈচিত্র্য।
জীববিজ্ঞানী ম্যাকেঞ্জি ১৯৯৯ সালে জীববৈচিত্র্যের যে সংজ্ঞা দেন, তা হল- বিভিন্ন বাস্তুতন্ত্রের বিভিন্ন স্তরের জীবদের ক্ষেত্রে একই প্রজাতির জীবের জিনগত প্রকরন থেকে বিভিন্ন প্রজাতির বৈচিত্র্য সমূহ কে জীববৈচিত্র্য বলে।
উদাহরণ – যেমন ভারতবর্ষ পৃথিবীর
অন্যতম প্রধান জীববৈচিত্র্য সম্পন্ন দেশ, যেখানে বিশ্বের মোট ২,৫০,০০০ আবিষ্কৃত উদ্ভিদ
প্রজাতির প্রায় ৪৫,০০০ এবং ১৫,০০,০০০ প্রাণী প্রজাতির মধ্যে প্রায় ৭৫,০০০ প্রজাতির সমাবেশ দেখা যায়
ভারতে। যা পৃথিবীর ৫.৭% প্রানী প্রজাতি এবং ১১ % উদ্ভিদ প্রজাতি কে অন্তর্ভুক্ত
করে।
জীববৈচিত্র্য শব্দের ব্যবহারঃ
বন্যপ্রানী বিজ্ঞানী ও সংরক্ষণবিদ Raymond
F. Dasmann ১৯৬৮
সালে তাঁর লেখা বই “A Different Kind of Country” তে প্রথম ‘Biological Diversity’ শব্দটি ব্যবহার করেন। তবে Biological
Diversity শব্দটি ব্যাপক ভাবে ব্যবহৃত হতে
শুরু করে ১৯৮০ এর দশকে Thomas Lovejoy এর কাজের দ্বারা এবং Biological
Diversity টির সংক্ষিপ্তরূপ
হিসাবে ‘Biodiversity’ শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন
ওয়াল্টার জি. রোসেন ১৯৮৫ সালে এবং এটি কে ১৯৮৮
সালে জনসমক্ষে আনেন পতঙ্গবিদ E. O. Wilson । তাই দুবারে Pulitzer পুরস্কার বিজেতা E. O. Wilson কে জীববৈচিত্র্যের জনক বলা হয়। বর্তমানে
Biological Diversity টির থেকে Biodiversity শব্দটি বেশি ব্যবহৃত হয়।
জীববৈচিত্র্যের প্রকারভেদ :
জীববৈচিত্র্যকে তিনটি পারস্পারিক সম্পর্কযুক্ত তিনটি শ্রেণীতে ভাগ করা যায়, যথা – জিনগত বৈচিত্র্য, প্রজাতিগত বৈচিত্র্য ও বাস্তুতান্ত্রিক বৈচিত্র্য।
ক. জিনগত বৈচিত্র্য (Genetic diversity) – একই প্রকার জীবের মধ্যে যে জিনগত প্রাচুর্য বা প্রকরন দেখা যায়, তাকে জিনগত বৈচিত্র্য বলে। একই প্রজাতিভুক্ত বিভিন্ন জীবের পারস্পারিক পার্থক্যকেই জন্মগত বা জিনগত বৈচিত্র্য বলে।
যেমন – প্রতিটি মানুষ একে অন্যের থেকে আলাদা জিনগত বৈচিত্র্যের জন্য সহজেই পৃথক করা যায়।
একটি নির্দিষ্ট প্রজাতির মধ্যে জন্মগত জীব সংখ্যার সুষম বিকাশের জন্য জিনগত বৈচিত্র্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন। কারণ একটি প্রজাতির জিনগত বৈচিত্র্য হ্রাস পেলে প্রজাতির বিলুপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কেননা জিনগত বৈচিত্র্য একটি প্রজাতিকে পরিবেশ গত পরিবর্তনের সাথে অভিযোজন করতে সহায়তা করে।
খ. প্রজাতিগত বৈচিত্র্য (Species diversity) -
একটি নির্দিস্ট অঞ্চল বা বাস্তুতন্ত্রের মধ্যে যে বিভিন্ন প্রকার জীবের সমাবেশ দেখা যায়, তাকেই প্রজাতি গত বৈচিত্র্য বলে। সাধারণত জীববৈচিত্র্য বলতে এই প্রজাতিগত বৈচিত্র্য কেই বোঝানো হয়ে থাকে। ভিন্ন ভিন্ন বাস্তুতন্ত্রের প্রজাতিগত বৈচিত্র্য বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। পৃথিবীর প্রাকৃতিক অঞ্চল গুলির মধ্যে নিরক্ষীয় অঞ্চলেই সবচেয়ে বেশি সমৃদ্ধশালী প্রজাতিগত বৈচিত্র্য পরিলক্ষিত হয়। উদাহরন স্বরূপ বলা যায় – তৃণভূমির বাস্তুতন্ত্রে ভিন্ন ভিন্ন জীবের সমাবেশ।
গ. বাস্তুতান্ত্রিক বৈচিত্র্য (Ecological diversity) – পৃথিবীর বিভিন্ন বাস্তুতন্ত্র গুলির মধ্যে যে উদ্ভিদ ও প্রানীগত বিভিন্নতা রয়েছে, তাকেই বাস্তুতান্ত্রিক বৈচিত্র্য।
উদাহরন স্বরূপ বলা যায় – অরন্যের বাস্তুতন্ত্র, তৃনভূমির বাস্তুতন্ত্র , মরুভূমির বাস্তুতন্ত্র, জলাভূমির বাস্তুতন্ত্র ।
জীববৈচিত্র্য পরিমাপের পদ্ধতি বা কৌশল
বিভিন্ন আয়তনের ভৌগোলিক অঞ্চলে উপস্থিত জীববৈচিত্র্য পরিমাপের উদ্দেশ্যে ভিন্ন ভিন্ন জ্যামিতিক সূচক ব্যবহৃত হয়ে থাকে। জীববৈচিত্র্য দুটি প্রধান উপাদান দ্বারা পরিমাপ করা হয় –
১. প্রজাতির প্রাচুর্যতা (Species richness)
২. প্রজাতির সমতা (Species evenness)
১. প্রজাতির প্রাচুর্যতা (Species richness) – একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের মধ্যে পাওয়া প্রজাতির সংখ্যাকে বোঝায়। প্রজাতির প্রাচুর্যতা পরিমাপের পদ্ধতি গুলি হল -
ক) আলফা বৈচিত্র্য ( Alpha Diversity) – একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে উপস্থিত বিভিন্ন প্রকার জীবের বৈচিত্র্যকে আলফা বৈচিত্র্য বলে। আলফা বৈচিত্র্যের মাধ্যমে কোনো অঞ্চলে প্রজাতির প্রাচুর্য (Species
richness) সম্পর্কে জানা যায়। আলফা বৈচিত্র্যের মান বেশি হলে প্রজাতির প্রাচুর্যতা বেশি হবে।
খ) বিটা বৈচিত্র্য (Beta Diversity)– পাশাপাশি অবস্থিত দুটি অঞ্চলের মধ্যে যে প্রজাতিগত বৈচিত্র্য লক্ষ্য করা যায় তার মাত্রাকে নির্দেশ করে । বিটা বৈচিত্র্যের মান বেশি হওয়ার অর্থ দুটি অঞ্চলে উপস্থিত বিভিন্ন প্রজাতির মধ্যে সাদৃশ্য কম।
গ) গামা বৈচিত্র্য (Gamma Diversity) – একটি বৃহদায়তন ভৌগোলিক অঞ্চলের মধ্যে থাকা বিভিন্ন বাসস্থানের প্রজাতির প্রাচুর্যকে গামা বৈচিত্র্য বলে।
২. প্রজাতির সমতা (Species evenness) – একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে প্রাপ্ত প্রজাতির অনুপাত কে পরিমাপ করে। স্বল্প সমতা স্বল্প প্রজাতির
সমাবেশ কে নির্দেশ করে ।
Simpson index – এটি একটি বাসস্থানের প্রজাতির
সংখ্যাগত জীববৈচিত্র্য পরিমাপের জন্য ব্যবহৃত হয়। সিম্পসনের বৈচিত্র্য সূচকটি
প্রজাতির প্রাচুর্যতা ও সমতা দুটোকেই বিবেচিত করে।
Shannon index – একটি নিদিষ্ট সম্প্রদায়ের
প্রজাতির বৈচিত্র্যকে চিহ্নিত করতে Shannon diversity index ব্যবহৃত
হয়।
জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের পদ্ধতিঃ
উদ্ভিদ ও প্রাণী প্রজাতির রক্ষনাবেক্ষন, তাদের বিজ্ঞানসম্মত ব্যবহার ও পুনরুদ্ধারকে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ বলে।
জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের জন্য মূলত দুটি কৌশল অবলম্বন করা হয়। যথা –
অ) ইন-সিটু সংরক্ষণ – জীব প্রজাতিকে যখন তার নিজ প্রাকৃতিক পরিবেশে সংরক্ষণ করা হয়, তখন তাকে ইন-সিটু সংরক্ষণ বলে।
যেমন – সুন্দরবনের বাঘ ও সুন্দরী গাছকে সুন্দরবনের প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্রে সংরক্ষণ করাকে ইন-সিটু সংরক্ষণ বলা হয়। স্বস্থানে সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে জাতীয় উদ্যান, অভয়ারণ্য , জীবমন্ডল সংরক্ষণ অঞ্চল গড়ে তোলা হয়েছে।
আ) এক্স- সিটু সংরক্ষণ – জীব প্রজাতিকে যখন তার প্রাকৃতিক পরিবেশের বাইরে, অন্য কোনো মনুষ্য সৃষ্ট কৃত্রিম পরিবেশে সংরক্ষণ করা হয়, তখন তাকে এক্স-সিটু সংরক্ষণ বলে।
যেমন – বোটানিক্যাল গার্ডেন, চিড়িয়াখানা।
ক্রায়ো সংরক্ষণ – উদ্ভিদের পরাগ, বীজ, কোশ ও প্রানীর জিন কে খুব শীতল তাপমাত্রায় (-১৯০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ) সংরক্ষণ করাকে ক্রায়ো সংরক্ষণ বলে।
- UN ২০১০ সাল কে আন্তর্জাতিক জীববৈচিত্র্য সাল হিসাবে ঘোষণা করেছে।
- জীববৈচিত্র্য সম্পর্কীত আন্তর্জাতিক চুক্তি বা প্রোটোকল গুলি হল - ক) ১৯৯২ সালে ব্রাজিলের বসুন্ধরা সম্মেলন খ) কার্টেজিনা প্রোটোকল (২০০০) গ) নায়োগা প্রোটোকল (২০১০)