স্থিতিশীল উন্নয়নের
লক্ষ্য গুলি হল বিশ্বের সকল মানুষের আরো ভালো সুস্থির ভবিষ্যৎ প্রাপ্তির উদ্দেশ্যে
পরিকল্পনা করা। বিশ্ব ব্যাপী আমরা যে সকল সমস্যার সম্মুখীন হয়, যেমন – দারিদ্রতা,
বৈষম্য, জলবায়ু পরিবর্তন, পরিবেশ গত অবনমন, শান্তি ও ন্যায়বিচার প্রভৃতি মোকাবিলার
করে সমস্যার সমাধান করা। সকল কে সমান সুবিধা প্রদানের উদ্দেশ্যে ২০১৫ সালে ১৭ টি
পরস্পর সম্পর্কীত লক্ষ্য স্থির করা হয়েছে, যেগুলি ২০৩০ এর মধ্যে অর্জন করা খুবই
গুরুত্বপূর্ন।
প্রথম SDG সামিট অনুষ্ঠিত হয় ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের UN এর সদর দপ্তর New
York শহরে।
লক্ষ্য ১ – দ্রারিদ্রতা
মুক্ত করনঃ
(No Poverty)
বিশ্বব্যাপী দ্রারিদ্র
সীমার নিচে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা ক্রমশ অধপতিত হচ্ছে। যেমন - ১৯৯০ সালে যা ৩৬
% ছিল এখন ২০১৫ সালে তা ১০ % এ এসে পৌঁছায়। কিন্তু বর্তমানে COVID-19 অতিমহামারি দারিদ্র
লঘুকরণের যে প্রগতি তাতে বাধার সৃষ্টি করে তাকে বিপরীত (বৃদ্ধি ঘটিয়ে) পথে চালিত
করছে। UNU World Institute এর অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্প্রর্কীত গবেষনা সাবধান করেছে যে এই বিশ্বব্যাপী অতি মহামারীর ফলে
বিশ্বে দারিদ্রতা প্রায় ৫০ কোটি পর্যন্ত বৃদ্ধি পাবে, যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ৮%
মানুষকে অন্তর্ভুক্ত করবে। ১৯৯০ এর পর থেকে গত ত্রিশ বছরে যা প্রথম বার বৃদ্ধি
পাবে
বর্তমানে ৭০ কোটির অধিক
মানুষ যা মোট জনসংখ্যার ১০% এখনও তাদের দ্রারিদ্র সীমার নিচে বসবাস করছে, যারা
তাদের প্রাথমিক চাহিদা যেমন – স্বাস্থ্য, শিক্ষা, জল, শৌচালয় প্রভৃতি পূরনে অক্ষম।
লক্ষ্য ২ – ক্ষুধার্তের
অবলুপ্তি (
Zero Hunger)
গত কয়েক দশক ধরে যে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যার যে ক্রম হ্রাস মানতা দেখা গিয়েছিল, ২০১৫ এর পর থেকে আবার তা ক্রমশ ধীরে ধীরে বাড়তে শুরু করে। আজ প্রায় ৮২ কোটি মানুষ রাতের খাবার পায় না এবং এদের মধ্যে ১৩.৫ কোটি মানুষ মনুষ্য সৃষ্ট যুদ্ধ, জলবায়ুর পরিবর্তন ও অর্থনীতির অধোপতনের জন্য একবার ঠিক মতো খাবার পায় না।
World Food Programme এর মতে বর্তমানে COVID-19 অতিমহামারি সেই সংখ্যা কে ২০২০ সালে মধ্যে দ্বিগুন
করে দিতে পারে আরও ১৩ কোটি মানুষ কে অন্তর্ভুক্তির
মাধ্যমে। অর্থাৎ যে ৩০ কোটির বেশি মানুষের অনাহারে থাকার সম্ভাবনা রয়েছে, তাদের
খাবার জোগান প্রদানের যথাযথ ব্যবস্থা করতে হবে।
বর্তমানের এই ৮২ কোটি
ক্ষুধার্ত মানুষকে ও তার সঙ্গে ২০৫০ সালের
মধ্যে যে আরও ২০০ কোটি অতিরিক্ত মানুষ এই তালিকায় অন্তভুক্ত হবে তাদের খাদ্যের
ব্যবস্থার জন্য কৃষি প্রনালির যথাযথ বিকাশ ঘটাতে হবে।
লক্ষ্য ৩ – ভালো
স্বাস্থ্য ও সমৃদ্ধি ( Good Health and Well-being)
স্থিতিশীল উন্নয়নের
লক্ষ্যে সকল মানুষের বয়েসের মানুষের সুস্বাস্থ্য ও মঙ্গল সাধনের ব্যবস্থা করা।
কোভিড-১৯ অতিমহামারির আগে লক্ষ লক্ষ মানুষের স্বাস্থ্যের উন্নতিতে অগ্রগতি ঘটেছিল।
মানুষের প্রত্যাশিত আয়ুষ্কালের বৃদ্ধি ঘটেছে। স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় আরোও বেশি করে
গুরুত্ব প্রদান ও অর্থ বিনিয়োগ করা, স্বাস্থ্য সম্মত শৌচালয়ের ব্যবস্থা ও
চিকিৎসকের সংখ্যা বৃদ্ধির মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রান বাচানো সম্ভব।
কিন্ত বর্তমানে
কোভিড-১৯ এর জন্য সারা পৃথিবী বিশ্ব স্বাস্থ্য সংকটের সম্মুখীন হয়েছে।
লক্ষ্য ৪ – গুনগত শিক্ষা (Quality Education)
আর্থ- সামাজিক উন্নতি ও দ্রারিদ্রতার হাত থেকে মুক্তির অন্যতম পন্থা হল শিক্ষা। বিগত কয়েক বছর ধরে শিক্ষার সুবিধা ও স্কুলে ভর্তি হওয়ার প্রবন্তা বিশেষ করে মেয়েদের ক্ষেত্রে অনেকটাই বৃদ্ধি পেয়েছে। তা সত্ত্বেও ২০১৮ সালে প্রায় ২৬ কোটি শিশু যা বিশ্বের মোট শিশু জনসংখ্যার প্রায় ১৫% ।
২০২০ সালে কোভিড-১৯ মহামারির জন্য বিশ্বের বেশির ভাগ দেশের বিদ্যালয় বন্ধ রয়েছে, যা প্রায় ৯১% ছাত্রছাত্রীকে প্রভাবিত করেছে। ২০২০ সালের আগস্ট মাসে অবধি প্রায় ১৬০ কোটির মতো শিশু ও যুবক বিদ্যালয় থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় রয়েছে।
লক্ষ্য ৫ – লিঙ্গ বৈষম্য দূরীকরণ ( Gender Equality)
লিঙ্গ গত সমতা মানুষের মৌলিক অধিকার। এক্ষেত্রে বর্তমানে যথেষ্ট অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে। যেমন – মেয়েরা বিদ্যালয়ে ভর্তি হচ্ছে, বাল্য বিবাহের প্রবনতা হ্রাস পাচ্ছে, অনেক বেশি মহিলা নেতৃত্ব প্রদান করছে এবং লিঙ্গ বৈষম্য দূরীকরনের জন্য বিভিন্ন আইন প্রনিত করা হচ্ছে।
লক্ষ্য ৬ – পানীয় জল ও
শৌচালয়ের ব্যবস্থা করা ( Clean water and Sanitation)
গ্রামীণ এলাকায় স্বচ্ছ পানীয় জল ও শৌচালয়
ব্যবস্থার যথেষ্ট বিকাশ ঘটানো সম্ভব হলেও এখনও এই পরিসেবার যথেষ্ট অভাব রয়েছে, যেমন বিশ্ব ব্যাপী ৩ জনের মধ্যে ১ জন স্বচ্ছ জল পায় না।
লক্ষ্য ৭ – সহজ প্রাপ্ত বিদ্যুৎ প্রদান( Affordable and clean energy)
সকলের জন্য সহজ প্রাপ্য বিদ্যুতের ব্যবস্থা করা, বিশেষ করে উন্নয়ন শীল দেশের গরীব মানুষদের কাছে বিদ্যুৎ পৌছে দেওয়া এবং অচিরাচরিত পুনর্ভব শক্তির অগ্রগতির ব্যবস্থা করা।
বিশ্বের ৩০০ কোটি মানুষের কাছে পরিষ্কার ও নিরাপদ রান্নার জ্বালানির ব্যবস্থা, পুনঃনবীকরণ শক্তির ব্যবহার ও আফ্রিকার সাহারা মরুভূমির আশেপাশের দেশ গুলিতে বিদ্যুতের জোগান দেওয়া।
লক্ষ্য ৮ – কর্ম সংস্থান ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন (Decent work & Economic
Growth)
অর্থনৈতিক উন্নয়ন কাজের সৃষ্টি করে জীবনযাত্রার মানের বিকাশে সাহায্য
করে। বিশ্বের ৫ টি দেশ যেখানে কোটি কোটি মানুষের বাসসেখানে ২০২০ সালে মাথাপিছু
উপার্জন অনেকটাই কমে গিয়েছে। বর্তমানে এই অতিমহামারি এই পরিস্থিতি কে আরো জটিল করে
দিচ্ছে। বিশ্ব শ্রমিক সংগঠনের মতে বিশ্বের প্রায় অর্ধেক শ্রমিক তাদের কাজ হারিয়ে
ফেলতে পারে।
লক্ষ্য ৯ – পরিকাঠামোর
বিকাশ, নতুন শিল্পায়ন ও উদ্যোগ গ্রহন (Industries,
Innovation & Infrastructure)
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে স্থিতিশীল উন্নয়ন ও জনগনের কর্ম সংস্থানের লক্ষ্যে পরিকাঠামোর বিকাশ যেমন – রাস্তা, জলসেচ, শক্তি সম্পদ ও তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির খুবই গুরুত্ব পূর্ন।
শিল্পজাত দ্রব্যের
উৎপাদনও অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও কর্ম সংস্থানে সাহায্য করে এবং প্রযুক্তি সম্পদের
কার্য কারিতা বাড়িয়ে পরিবেশগত উদ্দেশ্য গুলি সাধনে সাহায্য করে। প্রযুক্তি ছাড়া
শিল্পায়ন হবে না, শিল্পায়ন ছাড়া উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাই প্রযুক্তির ক্ষেত্রে আরও
বেশি করে বিনিয়োগ করতে হবে।
লক্ষ্য ১০ – অসাম্যতা কমানো ( Reduced Inequality )
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মধ্যে ও একটি দেশের অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে যে অর্থনৈতিক বৈষম্য আছে, বিশেষ করে অনুন্নত ও উন্নয়ন শীল দেশ গুলির মধ্যে তা দূরীকরনের জন্য যথপোযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহন করতে হবে। এই অসাম্যতা দূরীকরণের জন্য এমন পলিসি গ্রহন করতে হবে যেখানে সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।
লক্ষ্য ১১ – বসবাসের
উপযুক্ত নাগরিক পরিবেশ গড়ে তোলা ( Sustainable cities and communities)
নগরগুলি মানুষকে উন্নত আধুনিক সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিসেবা দিয়ে থাকে। এই নগর গুলিই হল বানিজ্য, সংস্কৃতি, সামাজিক বিকাশ ও আরো অনেক কিছুর কেন্দ্র বিন্দু। ২০৩০ সালের মধ্যে পৃথিবীর প্রায় ৫০০ কোটি মানুষ শহর ও নগরে বসবাস করবে। তাই শহর গুলিকে মানুষের বসবাসের অনুকূল করে তুলতে হবে।
লক্ষ্য ১২ - দায়িত্বশীল উৎপাদন ও ভোগ (Responsible consumption and Production)
প্রযোজন অনুযায়ী উৎপাদন ও গ্রহনের মাধ্যমে সম্পদ ও শক্তির কার্যকারিতা অনেক তাই বাড়ানো সম্ভব। এটি সামগ্রিক বিকাশে, ভবিষ্যতের জন্য সম্পদ সঞ্চয়ে পরিবেশ গত উন্নয়নে সাহায্য করে। যেহেতু এর অন্যতম লক্ষ্য হল কম পরিমান সম্পদ ব্যবহার
করে আরও ভালো ও উন্নত দ্রব্য মানুষের কাছে পৌছে দেওয়া, তাই এর ফলস্বরূপ সম্পদের
সঞ্চয়, পরিবেশ দূষণ ও অবনমনের পরিমান হ্রাস ও মানুষের জীবনযাত্রার মানের উন্নতি
ঘটছে।
লক্ষ্য ১৩ – পরিবেশ
দূষন রোধ (
Climate Action)
বর্তমানে পরিবেশ দূষণ পৃথিবীর প্রতি টি দেশ কে প্রভাবিত করছে। তাই এই দূষণের হাত থেকে রক্ষা পেতে পৃথিবীর প্রতি টি দেশ সম্মিলিত ভাবে বিভিন্ন প্রতিরোধ মূলক ব্যবস্থা গ্রহন করছে। যেমন – প্যারিস এগ্রিমেন্ট, যা ২০১৬ সাল থেকে কার্যকর হয়েছে। এই এগ্রিমেন্টে প্রতিটি দেশ বিশ্ব তাপমাত্রা বৃদ্ধিকে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমিত রাখার জন্য কাজ করছে।
লক্ষ্য ১৪ – জলজ জীবের সংরক্ষণ ( Life below water)
পৃথিবীর মহাসাগর গুলির তাপমাত্রা, লবণটা, স্রোত ও জীবন পৃথিবীকে মানুষের বাসস্থানের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। বৃষ্টি, পানীয় জল, আবহাওয়া, জলবায়ু, খাদ্য, এমনকি অক্সিজেনও আমাদের দেয়। তাই সামুদ্রিক পরিবেশ কে সুস্থ রাখতে সংরক্ষনের ব্যবস্থা করতে হবে। যেমন – অতিরিক্ত মৎস্য শিকার বন্ধ, সামুদ্রিক দূষণ রোধ ।
লক্ষ্য ১৫ – স্থলজ জীবের সংরক্ষণ ( Life on Land)
পৃথিবীর মোট ভূভাগের প্রায় ৩০.৭ % দখল করে আছে অরণ্য। যা আমাদের খাদ্য, বাসস্থান দেয়, পরিবেশ দূষণ থেকে বাচায়, জীব বৈচিত্র্য রক্ষা করে ও মানুষের গৃহ রক্ষা করে। তাই পরিবেশ সংরক্ষণের
মাধ্যমে আমরা মরুকরণ, ভূমির অবনমন ও জীব বৈচিত্র্য হ্রাসের হাত থেকে
রক্ষা পেতে পারি।
কিন্তু বর্তমানে আমরা প্রতি বছর ১.৩ কোটি হেক্টর বনভূমি হারিয়ে ফেলছি।
লক্ষ্য ১৬ - মানুষের মৌলিক অধিকার রক্ষা করা ( Peace, Justice and strong
institution)
আন্তজাতিক মানব হত্যা,
শিশু দের উপর অত্যাচার, মানব পাচার এবং যৌন নির্যাতন প্রভৃতি সমস্যা থেকে মুক্তি
স্থিতিশীল উন্নয়নের লক্ষ্যে পৌছাতে
সাহায্য করে। গত দশকে নরহত্যা ও মানব পাচারের পরিমান অনেকটাই বৃদ্ধি পেয়েছে। দক্ষিন আমেরিকা, আফ্রিকার সাব- সাহারান দেশ
গুলিতে ইচ্ছা কৃত মানব হত্যার পরিমান অনেকটাই বেশি। শিশু দের উপর অত্যাচারের ঘটনাও
বিশ্বব্যাপী অনেকটা বেড়ে গিয়েছে।
এই সমস্যা গুলি থেকে
মুক্তি পেতে আরও অনেক জাতীয় মানবাধিকার কমিশন গড়ে তুলতে হবে সারা পৃথিবীতে।
লক্ষ্য ১৭ – লক্ষ্য ভেদ
করতে অংশীদারিত্ব গ্রহন করা (Partnership and Goals)
স্থিতিশীল উন্নয়নের জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশ, প্রাইভেট সেক্টর ও সিভিল সোসাইটির মধ্যে সম্মিলিত সক্রিয় অংশগ্রহণ আবশ্যক।